|
|
|
|
হৃদয়ের সাড়া না থাকলে এটা করা যেত না |
সুভাষ দত্ত |
দশমীর রাতে দেখেছিলাম। শুক্রবার আবার। পরপর দু’দিন বাবুঘাটের গঙ্গায় বার্জের উপরে দাঁড়িয়ে বিসর্জন দেখতে দেখতে একটা প্রশ্ন মনে এল। ‘পরিবর্তন’ কাকে বলে? পরিবর্তন মানে কি শুধু দীর্ঘ দিনের ক্ষমতাসীন একটি রাজনৈতিক দলকে ভোটের ময়দানে হারিয়ে অন্য একটি দলের ক্ষমতায় আসীন হওয়া? না কি পরিবর্তন বলতে বুঝব, দৃষ্টিভঙ্গির বা মানসিকতার পরিবর্তন? সত্যকারের সমস্যাকে হৃদয় দিয়ে বোঝার মানসিকতার পরিবর্তন? আমার মনে হয়, দ্বিতীয়টা।
সেই ’৮৪-র ফেব্রুয়ারিতে নদীর পাড় ধরে হেঁটে হেঁটে দূষণের ছবি তোলা শুরু করেছিলাম। সে দিন কিন্তু মাত্র দশ পা-ও হাঁটতে পারিনি। কারণ, তখন গোটা গঙ্গার পাড়টাই কার্যত শৌচাগার। এর পরে গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। বিস্তর আইনি লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। অনেকেই তা জানেন।
আসলে, একটি শহর কতটা ঐতিহ্যপূর্ণ বা আভিজাত্যপূর্ণ, তা বোঝা যায় তার নদীর পাড় বা সমুদ্রতট দেখে। তিলোত্তমা কলকাতার ওই দশা দেখে আমার বিবেক দংশন হল। আমি গঙ্গার উপরে কাজ শুরু করলাম। সব তথ্য ও গঙ্গার কেন এই হাল, তা বুঝলাম। ’৮৫-তে এল ‘গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যান’। তেমন কাজের কাজ হল না।
দেখলাম, বহু খরচ হয়েছে, কিছু মানুষ বিত্তবান হয়েছেন, কিন্তু ভাগের মা গঙ্গা পাননি। ’৯৭ সালে রাজ্যের গঙ্গা-দূষণের বিষয়টা সুপ্রিম কোর্ট কলকাতা হাইকোর্টের কাছে পাঠাল। সমস্ত তথ্য, ছবি সবিস্তার আদালতের সামনে তুলে ধরলাম। ২০০০ সালে এই বিসর্জনজনিত গঙ্গাদূষণ নিয়ে হাইকোর্টের গ্রিন বেঞ্চে আলাদা মামলা রুজু করলাম। হাইকোর্ট আদেশ দিল, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিসর্জনের সমস্ত কাঠামো তুলে ফেলতে হবে। আদালতের নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদও নির্দেশ জারি করল, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সমস্ত কাঠামো তুলে ফেলতে হবে।
মা দুর্গা হয়তো অলক্ষ্যে হাসলেন, কে আমার কাঠামো তুলবে? কিছুই হল না। কে তুলবে, সেই বিষয়টারই ফয়সালা হল না। অবস্থা রইল সেই তিমিরেই। ২০০৬-এ টেমস পরিষ্কারের কাজে অংশ নিতে গেলাম। দেখলাম, লন্ডন পোর্ট অথরিটি নদী পরিষ্কারে সক্রিয় ভাবে সামিল হয়। কলকাতা হাইকোর্টে জানালাম, কলকাতা বন্দর কর্তৃপক্ষও যেন এ কাজে এগিয়ে আসেন। ২০০৯-এ কলকাতা হাইকোর্ট বলল, পুরসভা ও পোর্ট ট্রাস্ট যৌথ ভাবে এ কাজ করবে। তার পরে রাজ্যের ৪২টি পুরসভাকেই আদালত বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যৌথ ভাবে এই কাজ করতে বলল। ২০১০-এ পোর্ট ট্রাস্ট এগিয়ে এল, সঙ্গে কলকাতা পুরসভা। তাতেও তেমন কিছু হল না।
এ বার কিন্তু ছবিটা একেবারে বদলে যেতে দেখলাম। বাবুঘাটে উপস্থিত থেকে দেখছি, প্রতিমা বিসর্জনের সঙ্গে সঙ্গে ক্রেন দিয়ে সেই কাঠামো তুলে পাড়ে রাখা হচ্ছে। পুরসভা যে তৎপরতার সঙ্গে কাঠামো সরিয়ে নিয়েছে, তা দেখে আমার মনে হয়েছে, সদিচ্ছা ও হৃদয়ের টান না থাকলে কাজটা এই ভাবে করা যায় না। হৃদয়ের পরিবর্তন তো অবশ্যই হয়েছে। এটা কিন্তু গোটা ভারতবর্ষে ও বিশ্বের কাছে একটা আলাদা বার্তা দেবে যে, এ ভাবেও দূষণ কমানোর প্রয়াস নেওয়া যায় এবং নির্মল গঙ্গা আমরা করতে পারি। অষ্টমীতে মায়ের কাছে প্রার্থনা করেছিলাম, মা তোমার নিরঞ্জন যেন খুব সুন্দর ভাবে হয়। মা আমার প্রার্থনা মঞ্জুর করেছেন।
আমার দীর্ঘ লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, ২০১১ সালে যে সাফল্য পেলাম, তা এক কথায় অভূতপূর্ব। আশা করব, ছবিটা আর বদলাবে না। বরং, ছড়িয়ে যাবে বিসর্জনের অন্য ঘাটগুলিতে! |
|
|
|
|
|