তখনও সন্ধ্যা নামেনি। একে একে লরি এসে থামছে বাজেকদমতলা ঘাট (বাবুঘাট) ও জাজেস ঘাটে। লরি থেকে প্রতিমা নামানোর পরে চটজলদি খুলে নেওয়া হচ্ছে তাদের ফুলের সাজ, হাতের অস্ত্র। সেগুলি রাখা হচ্ছে টিনের বেড়া দিয়ে নির্দিষ্ট করা একটি জায়গায়। এর পরেই প্রতিমা নিয়ে যাওয়া হচ্ছে গঙ্গায়, বিসর্জনের জন্য। তবে বিসর্জন দেওয়া হচ্ছে গঙ্গার বুকে দড়ি দিয়ে চিহ্নিত করে দেওয়া গণ্ডির ভিতরেই। দিনে বিসর্জনের সংখ্যা অনেক কম হওয়ায় কাঠামো কিছু দূর ভেসে যেতে পারলেও রাতে সে উপায় নেই। বিসর্জনের পরেই বাবুঘাটে বন্দর-কর্তৃপক্ষের ক্রেন সেই প্রতিমা তুলে আনছে। এর পরে তার স্থান হচ্ছে গঙ্গাপাড়ের এক ধারে। প্রতিমা নিরঞ্জনের জন্য এ বছর গঙ্গার ঘাটগুলিতে গিয়ে এমনই এক বিরল দৃশ্য চোখে পড়ল শহরবাসীর।
গঙ্গাকে দূষণমুক্ত রাখতে এ বার এই বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছে কলকাতা পুরসভা। এ কাজে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন কলকাতা বন্দর-কর্তৃপক্ষও। এমনকী, পরিবেশ দূষণ রুখতে নতুন এই ব্যবস্থায় শরিক হয়েছেন সাধারণ মানুষও।
তবে, বাবুঘাটে ক্রেনের ব্যবস্থা থাকলেও খানিক দূরে জাজেস ঘাটে অবশ্য কোনও ক্রেন নেই। তাতে অবশ্য কোনও অসুবিধা হয়নি। জাজেস ঘাটে যে সংস্থা জল থেকে প্রতিমা তোলার বরাত পেয়েছে, তাদেরই প্রতিনিধি সমর সেনগুপ্ত বললেন, “ভাটায় প্রতিমা ডুবে যায় জলের তলায়। কিন্তু ভরা জোয়ারে জলের তোড়ে তা গণ্ডি ছাড়িয়ে চলে যায়। তাই গঙ্গার যেখানে দড়ি ফেলে গণ্ডি কাটা আছে, তার ধার ঘেঁষে বিসর্জনের সময়ে দু’টি নৌকো ও একটি লঞ্চ রাখা হয়েছে, যাতে লাঠি হাতে কয়েক জন কর্মী সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে। কোনও প্রতিমার দড়ির গণ্ডি পার হওয়ার সম্ভবনা দেখা দিলে লাঠি দিয়ে ঠেলে সেটি গণ্ডির ভিতরে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই সময়ের মধ্যেই জলে নামা আমাদের কর্মীরা প্রতিমার কাঠামোর ভিতর দিয়ে মোটা দড়ি গলিয়ে তা টেনে আনছে পাড়ের কাছে। প্রতিমার মাটি ধুয়ে যেতেই তা পাড়ে তোলা হচ্ছে, যাতে পুরসভা সেগুলি নিয়ে যেতে পারে।’’ প্রতিমাগুলি যাতে জলের তোড়ে না ভেসে যায়, তাই জাজেস ঘাটের পাশাপাশি বাজেকদমতলা ঘাটেও পাড় থেকে জলের খানিকটা অংশ দড়ি দিয়ে ঘিরে দিয়েছেন কলকাতা বন্দর-কর্তৃপক্ষ। |
শুক্রবার সকালে মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় ও মেয়র পারিষদ (উদ্যান) দেবাশিস কুমার বাবুঘাটে হাজির হয়ে কাঠামো সরানোর কাজের তদারকি করেন। মেয়র বলেন, “বাবুঘাটে বন্দর-কর্তৃপক্ষ একটি ক্রেন দিয়েছেন জল থেকে কাঠামো তোলার জন্য। আমরা গঙ্গাপাড় থেকে লরিতে কাঠামো তোলার জন্য পুরসভার একটি ক্রেন ব্যবহার করছি। পুরসভার লরি সেগুলি তুলে নিয়ে ফেলে আসছে ধাপায়। এই কাজে পুরসভার ৩৫০ জন কর্মীকে নিযুক্ত করা হয়েছে।” তিনি বলেন, “বন্দর, পুলিশ, পুরসভা সকলকে সঙ্গে নিয়ে এই কাজে নামতে নির্দেশ দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাতেই কাজটি সহজ হল। আগামী বছর কলকাতার অন্যান্য ঘাট-সহ কেএমডিএ এলাকায় গঙ্গার বাকি ঘাটগুলিতেও একই রকম ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা আছে।”
মেয়র পারিষদ (উদ্যান) দেবাশিস কুমার বলেন, “এ বারের অভিজ্ঞতা থেকে ঠিক করেছি, পরের বার বন্দর-কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে একটি বড় বার্জ পেলে পরিত্যক্ত কাঠামো আর বিভিন্ন ঘাটের পাড়ে তুলব না। সেগুলি সরাসরি বার্জে তুলে দইঘাটের মতো কম ভিড়ের জায়গায় নিয়ে গিয়ে রাখব। এর ফলে সেগুলি পুরসভার লরিতে তোলা অনেক সহজ হবে।”
তিনি আরও জানান, শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত ১৫০ লরিরও বেশি পরিত্যক্ত কাঠামো ধাপায় ফেলা হয়েছে। গঙ্গাপাড়েই পুরসভার সাতটি পে-লোডার দিয়ে পরিত্যক্ত কাঠামোগুলি ভাঙা হচ্ছে। তার পরে তা তোলা হচ্ছে লরিতে। গঙ্গায় যাতে কোনও পরিত্যক্ত কাঠামো পড়ে না থাকে, তাই সোমবার পর্যন্ত পুরসভার ৪০টি লরি ওই কাজ করবে।
পুলিশ কমিশনার রঞ্জিতকুমার পচনন্দা বলেন, “প্রতিটি ঘাটেই উপযুক্ত সংখ্যায় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর কর্মীরা রয়েছেন। যে কোনও পরিস্থিতির মোকাবিলাতেই আমরা প্রস্তুত।” কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (সদর) জাভেদ শামিম এ দিন জানান, দশমীর রাত থেকে একাদশী ভোর পর্যন্ত ছোটবড় মিলিয়ে ২২৭৬টি প্রতিমা বিসর্জন হয়েছে। প্রচলিত ১৯টি ঘাট ছাড়া বিভিন্ন পুকুরে বিসর্জন হয়েছে। প্রতিটি ঘাটে বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর দু’জন কর্মী মোতায়েন রয়েছেন। রয়েছে নৌকাও। |
বাবুঘাট ও জাজেস ঘাট, দুই জায়গায় কর্মরত পুলিশকর্মীদের কথায়, কলকাতায় এত সুন্দর ব্যবস্থা করা হলেও হাওড়া, হুগলিতে এখনও ওই ব্যবস্থা হল না। করলে ভাল হয়।
বাবুঘাট ও জাজেস ঘাটে রবিবার পর্যন্ত চলবে প্রতিমা নিরঞ্জন। প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া ও তার কাঠামো তুলে এনে পাড়ে রাখার কাজ করছেন বন্দরের ৪০ জন শ্রমিক। তবে বড় কাঠামো দ্রুত তোলার জন্য ভাসমান ক্রেনের ব্যবস্থা রয়েছে। ওই ক্রেন রাখা থাকছে বার্জের উপরে। এ ছাড়া, তিনটি লঞ্চ ও ছ’টি যন্ত্রচালিত বোট ক্রমাগত কাঠামো তুলে পাড়ে নিয়ে আসছে।
পাশাপাশি, প্রতিমা বিসর্জনের সময়ে কোনও রকম দুর্ঘটনা এড়াতে থাকছে ডুবুরির দলও। প্রতিনিয়ত স্পিড বোটে করে পাঁচ সদস্যের ডুবুরির দল চক্কর কাটছে ঘাটে।
শুধু দুর্গাপুজোই নয়, কালীপুজোর বিসর্জনের জন্যও তিন দিন ধরে এই একই ব্যবস্থা থাকবে বলে বন্দর-কর্তৃপক্ষের তরফে জানানো হয়েছে। |