|
|
|
|
টাচ স্ক্রিন ছুঁতে এখনও আড়ষ্ট বাঙালি |
পিনাকী বন্দ্যোপাধ্যায় • কলকাতা |
মোবাইল ব্যবহারে রীতিমতো দক্ষ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। হাতের মোবাইল থেকেই বহু জরুরি কাজ তৎক্ষণাৎ করে ফেলতে তাঁর জুড়ি নেই। ক্রমাগত মেসেজ করতেও তিনি অক্লান্ত। নতুন, উন্নততর যে কোনও প্রযুক্তিকে তিনি সর্বদা স্বাগত জানান। তবু আইফোনের টাচ-স্ক্রিন প্রযুক্তি তিনি এখনও নেননি।
বণিকসভা ফিকি-র প্রাক্তন সেক্রেটারি জেনারেল অমিত মিত্র এখন রাজ্যের অর্থমন্ত্রী। আশির দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অমিতবাবু যখন অর্থনীতি নিয়ে পড়াশুনো করেছেন, তখন থেকেই তিনি অ্যাপল ব্র্যান্ডের সঙ্গে পরিচিত। তবু তাঁর হাতে আজও আইফোন নেই। ব্যবহার করেন ব্ল্যাকবেরি।
কেন? মমতা বলেন, “প্রতি মুহূর্তে আমাকে মেসেজ করতে হয়। সে ক্ষেত্রে আইফোনের টাচ স্ক্রিনের চেয়ে ব্ল্যাকবেরি বা ওই রকম অন্য কোনও ফোন আমার পক্ষে সুবিধাজনক। আমি স্বচ্ছন্দ বোধ করি। কারণ মোবাইল আমার কাছে বিলাসিতা নয়, প্রয়োজন।” তাঁর সরকারের অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য: “আমার যে ধরনের কাজ, তাতে ব্ল্যাকবেরি দিয়েই চলে যায়।”
মোবাইল বাদ দিলে বাকি সবেতেই মমতা কিন্তু জোবসের গুণমুগ্ধ গ্রাহক। এতটাই যে, জোবসের ‘অকালমৃত্যু’ তাঁকে ‘ধাক্কা দিয়েছে’। মমতার কথা, “আমার আইপ্যাড এবং একাধিক আইপড আছে। আইপ্যাডে টাচ স্ক্রিন ব্যবহার করতেও আমার কোনও অসুবিধা হয় না। কারণ তখন তো দ্রুত মেসেজ করার মতো চাপ থাকে না।” মমতার কাছে আইপডের একটি ক্ষুদ্রতম সংস্করণও আছে। যাতে তিনি নিয়মিত গান শোনেন। অমিতবাবুর আইপ্যাড-ও নেই এখনও। |
|
|
|
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় |
অমিত মিত্র |
যোগেন চৌধুরী |
|
এঁরা কেউ কোনও বিচ্ছিন্ন উদাহরণ নন। রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী এবং পশ্চিমবঙ্গ শিল্পোন্নয়ন নিগমের চেয়ারম্যান থাকাকালীন নিরুপম সেনও চুটিয়ে ব্ল্যাকবেরি ব্যবহার করেছেন। ‘ব্ল্যাকবেরিতে কাজ চলে যায়’-এর যুক্তিতে তিনিও আইফোনের মতো উন্নত প্রযুক্তির মোবাইলের দিকে ঝোঁকেননি। তাঁরও বক্তব্য: “যখন মন্ত্রী ছিলাম, মেল চেক করে তার উত্তর দেওয়া থেকে চটজলদি মেসেজ করা, প্রয়োজনে কোনও লগ্নিকারী সংস্থার চিঠি নিগমের আধিকারিকরা পিডিএফ ফাইল করে পাঠিয়ে দিলে তা ডাউনলোড করে দেখে নেওয়া, সবই ব্ল্যাকবেরিতে হয়ে যেত।”
আজ একুশ শতকের দশটি বছর পেরিয়ে এসেও এমনই এক মানসিকতা আঁকড়ে রেখেছেন বহু ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত বাঙালিরা। তাঁরা স্টিভ জোবসের নাম জানেন। জানেন আধুনিক প্রযুক্তির মোবাইল ফোনের জগতে তাঁর অবদানের কথাও। কিন্তুস্টিভের সেই মগজাস্ত্র নানা কারণে আজও তাঁদের অনেকেরই দৈনন্দিন জীবনে সর্বক্ষণের সঙ্গী হতে পারেনি। কারও বক্তব্য, এত আধুনিক প্রযুক্তির ‘সফিসটিকেটেড’ ফোনের প্রয়োজন হয় না। কারও আবার অনীহা রয়েছে, স্টিভের ‘মগজ খনি’র ভিতর ঢুকে মণি-রত্ন (সফট্ওয়্যার অ্যাপ্লিকেশনস) খুঁজে বের করার জন্য মাথা ঘামানোর। কয়েক জনের কাছে আবার ফোন ধরা এবং বড়জোর ফোন করার বাইরে মোবাইল প্রকৃতপক্ষে দূরের গ্রহ। সব মিলিয়ে যার নিট ফল, স্টিভ জোবসের স্বপ্নের আইফোন আজও অনেকটা ব্রাত্য হয়ে রয়ে গিয়েছে প্রতিষ্ঠিত বাঙালি সমাজে। আইপ্যাড তো আরও দূরের কথা।
নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে অভ্যস্ত হতে না-পারার কোনও অজানা ‘ভয়’ কি এ সবের পিছনে কাজ করে? যাঁরা এই ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করেন না, তাঁরা অবশ্যই ভিন্ন যুক্তি দেন। আর যাঁরা ব্যবহার করেন, তাঁদের মতে, বাধাটা অবশ্যই মানসিক।
সারা বিশ্ব চষে বেড়ান কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়। মার্কিন প্রযুক্তি ভারতে নিয়ে আসার ক্ষেত্রেও তিনি যথেষ্ট সক্রিয়। তবু ‘কম্পিউটর-সুলভ’ স্মৃতিশক্তির অধিকারী এই মানুষটি আইফোন ব্যবহার তো কোন ছাড়, মোবাইলকে শুধু ফোন ধরা বা করার জন্য ব্যবহার করেন। মেসেজ করতেও সড়গড় হননি। স্টিভ জোবস এবং তাঁর প্রযুক্তি সম্পর্কে রীতিমতো ওয়াকিবহাল প্রণববাবুর ব্যক্তিগত ব্যবহারের নিরিখে তাই আইফোন, আইপ্যাড ইত্যাদি কয়েকটি শব্দ মাত্র।
চিত্রশিল্পী যোগেন চৌধুরীর কাছে আইফোন না থাকলেও, দু’টো আইপ্যাড আছে। কিন্তু ‘সময়ের অভাবে’ তার কোনওটাই তাঁর ব্যবহার করা হয়ে ওঠে না। একটি আইপ্যাড যোগেনবাবুর এক বন্ধু উপহার দিয়েছিলেন। অন্যটি তিনি নিজেই শখ করে কিনেছিলেন। দু’টিরই এখন ঠাঁই হয়েছে যোগেনবাবুর শান্তিনিকেতনের বাড়ির ড্রয়ারে। তিনি বলেন, “ওগুলির সম্পূর্ণ ব্যবহার শিখতে গেলে যে ভাবে ধৈর্য ধরে শিখতে হয়, সে সময় আমার নেই। বাড়ির সাধারণ কম্পিউটারেই টুকটাক যা প্রয়োজন হয়, সেরে ফেলি।”
যদিও অমিতবাবু, নিরুপমবাবু, যোগেনবাবু সবাই মনে করেন, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার যে কোনও মানুষকেই অন্যের থেকে এগিয়ে রাখে। এতে পেশাগত কাজেও অনেক সুবিধা হয় এবং আইফোনের মতো একটি প্রযুক্তি হাতে থাকলে সারা দুনিয়াই হাতের মুঠোয় চলে আসে। তাই অমিতবাবু জানিয়েছেন, কাজের স্বার্থে খুব শীঘ্রই তিনি একটি আইপ্যাড কিনবেন।
মানসিক বাধার দেওয়াল ভেঙে আইফোন, আইপ্যাড কিনে ফেলেছেন যাঁরা, তাঁদের ভাবনা আবার অন্য রকম। প্রজন্মের ব্যবধান ঘুচিয়ে পিয়ারলেস গোষ্ঠীর কর্ণধার সুনীলকান্তি রায় নব-প্রযুক্তির সুফলটুকু গ্রহণ করতে সম্প্রতি একটি আইফোন কিনে ফেলেছেন। কেন? সুনীলবাবুর বক্তব্য, “এত আধুনিক, সংবেদনশীল প্রযুক্তি ব্যবহার করলে তবেই সময়ের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া যায়। কলকাতায় বসে বিদেশে মেয়ের সঙ্গে কথা বলা থেকে শুরু করে অফিসে না গিয়ে বাড়িতে বসেও পুরো অফিসের কাজই আইফোনের মাধ্যমে যেন চোখের সামনে থাকে।” আর ঠিক সেই কারণেই তিনি এখন দিনের অনেকটা সময় কাটান আইফোন নিয়ে। তাঁর ছেলে জয়ন্ত রায় অবশ্য বেশ কিছু দিন আগে একটি আইফোন কিনেছেন। সুনীলবাবুর মন্তব্য, “জয়ন্ত আজকাল আইফোনই ব্যবহার করছে। ওই ফোনের সফটওয়্যার অ্যাপ্লিকেশনগুলির পরিচালনায় ও অনেকটাই অভ্যস্ত। আমি চেষ্টা করছি শেখার।” আইপ্যাড ব্যবহার করতে করতে এখন অন্য কিছু ভাবতে পারেন না একটি বহুজাতিক সংস্থার শীর্ষকর্তা রূপেন রায়।
কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ও আইফোন বাজারে আসার পরেই তা কিনে ব্যবহার করছেন। মেয়র বলেন, “সারা দিন আইফোনটাই আমার কাছে কম্পিউটার। দ্রুত ইন্টারনেট যোগাযোগ করা যায়। যে কোনও তথ্য যখন-তখন হাতের মুঠোয় চলে আসে।” একই ভাবে আইফোন ব্যবহারে নিজেকে অভ্যস্ত করে তুলেছেন সিপিএমের প্রাক্তন মন্ত্রী মানব মুখোপাধ্যায়। যাঁর দাবি, “শেখার ইচ্ছে থাকলে উপায় হয় না, এ আমি মানি না।” |
|
|
|
|
|