গণতন্ত্রের লড়াইয়ে নোবেল তিন কন্যার
শান্তি, গণতন্ত্র এবং উন্নয়নের প্রশ্নে নারীর অধিকারকে অবিচ্ছেদ্য বলে ঘোষণা করে তিন কন্যার শান্তি অভিযানকে সেলাম জানাল নোবেল কমিটি। এ বছরের নোবেল শান্তি পুরস্কার পাচ্ছেন লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট এলেন জনসন-স্যরলিফ, লাইবেরিয়ারই সমাজকর্মী লেমা জিবোউয়ি এবং ইয়েমেনের মানবাধিকার-কর্মী তাওয়াকুল কারমান।
নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান থরবিয়র্ন ইয়াগলান্দ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, “সমাজের প্রতিটি স্তরে উন্নয়নের গতিকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে মেয়েরা যদি সমান সুযোগ এবং অধিকার না পান, পৃথিবীতে গণতন্ত্র এবং স্থায়ী শান্তি আসবে না কখনও।” সেই উপলব্ধি থেকেই সাত বছর পর নোবেল শান্তি পুরস্কার ফিরে এল মেয়েদের হাতে। এর আগে ২০০৪ সালে শেষ বার কেনিয়ার ওয়াঙ্গারি মাথাই এই পুরস্কার পান। মায়ানমারের নেত্রী আং সান সু চি, গুয়াতেমালার রিগোবার্তা মেঞ্চু, ইরানের শিরিন এবাদি নোবেল শান্তি পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন অনেকেই। কিন্তু এ বছর একসঙ্গে তিন জনকে পুরস্কার দিয়ে নোবেল কমিটি সামগ্রিক ভাবে নারী আন্দোলনের শক্তিকেই পুরস্কৃত করল বলে মনে করা হচ্ছে।
এই বছরটিতে পৃথিবীর একাধিক দেশে রাজনৈতিক পালাবদলের সূচনা হয়েছে। একাধিক দেশ এখনও আন্দোলন-বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে চলেছে। বিশেষত মিশর-তিউনিসিয়া-লিবিয়া-ইয়েমেন-সিরিয়া-বাহরিনের মতো আরব দুনিয়ার দেশগুলিতে যে গণআন্দোলন গড়ে উঠেছে, (এই আন্দোলন ‘আরব বসন্ত’ নামে চিহ্নিত) এ বারের শান্তি পুরস্কারে তার ছায়া পড়বে বলে জল্পনা ছিলই। ইয়েমেনের তাওয়াকুল কারমানের নোবেল সেই প্রত্যাশা পূরণ করেছে। মিশরের আন্দোলনের অন্যতমা নেত্রী আসমা মেহফুজ তাই বলছেন, “ইয়েমেনকে পুরস্কার দেওয়া মানে গোটা ‘আরব বসন্ত’ আন্দোলনকেই পুরস্কার দেওয়া। এটা আমাদের সকলের, আরব দুনিয়ার সব দেশের সম্মান।”
লাইবেরিয়ার এলেন
জনসন-স্যরলিফ
লাইবেরিয়ার
লেমা জিবোউয়ি
ইয়েমেনের
তাওয়াকুল কারমান
মিশর থেকে আসমা নিজে এবং আন্দোলনের আর এক আহ্বায়ক ইসরা আবদেল ফাতা বা তিউনিসিয়ার জননেত্রী লিনা বেন মেহন্নিও পুরস্কারের দৌড়ে ছিলেন। শেষ পর্যন্ত পুরস্কার গেল ইয়েমেনে। ইয়াগলান্দ এ প্রসঙ্গে একটি তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেছেন এ দিন। তিনি বলেছেন, মিশর, তিউনিসিয়া বা লিবিয়ার সঙ্গে ইয়েমেনের তফাৎ আছে। ইয়েমেনে আন্দোলন চলছে এখনও, পালাবদল আসেনি। এই সময় কারমানকে পুরস্কার দিয়ে নোবেল কমিটি ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট আলি আবদুল্লা সালেহ-কে গদি ছাড়ার বার্তাই দিল। কারমান নিজেও তাঁর নোবেল জয়কে ব্যাখ্যা করছেন এই ভাবেই: “পুরস্কারটা বুঝিয়ে দিচ্ছে, আরবে স্বৈরতন্ত্রীদের দিন শেষ।”
কিন্তু আরব দুনিয়ায় পরিবর্তনের লড়াইকে স্বাগত জানানোতেই কি শেষ হতে পারত নোবেল কমিটির কাজ? ইয়াগলান্দ বলছেন, না। পুরস্কার ঘোষণার কিছু আগে নরওয়ের সরকারি টিভি চ্যানেলে একটি সাক্ষাৎকারে তিনি স্পষ্ট করে দেন, শুধুমাত্র আরব দুনিয়াকে নিয়ে যারা মাথা ঘামাচ্ছেন, তাঁরা অন্য দিকগুলো দেখছেন না। “এ বছর আরও অনেক ইতিবাচক ঘটনা ঘটেছে। সেগুলো সম্পর্কে অবহিত না থাকাটা, আমার মতে একটু অদ্ভুত।” সুতরাং শুধুমাত্র আরব দুনিয়াতে আটকে না থেকে নোবেল কমিটি তার দৃষ্টি প্রসারিত করেছে আফ্রিকাতে। লাইবেরিয়ার মতো দেশে গৃহযুদ্ধের আবহ থেকে বেরিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয়েছে বেশ কয়েক বছর আগেই। এলেন জনসন-স্যরলিফ লাইবেরিয়া তথা আফ্রিকার ভূখণ্ডে প্রথম নির্বাচিত মহিলা প্রেসিডেন্ট। গৃহযুদ্ধের বছরগুলোতে নারী ও শিশুদের সংগঠিত করে হিংসার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন লেমা জিবোউয়ি। তিউনিসিয়া বা মিশরের আন্দোলন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে শিরোনাম হয়ে ওঠার অনেক আগেই কিন্তু এই লড়াইগুলো চলছিল। “খবরের শীর্ষে আসার আগে থেকে যাঁরা ছিলেন”, নোবেল কমিটি তাঁদেরও সম্মানিত করতে চেয়েছে।
২০০৩ পর্যন্ত এক লম্বা গৃহযুদ্ধে দীর্ণ ছিল লাইবেরিয়া। ২০০৫-এ ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসেন এলেন জনসন-স্যরলিফ। এ বছরই দ্বিতীয় বার নির্বাচনে দাঁড়াতে চলেছেন তিনি। ৭২ বছরের এলেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির কৃতী ছাত্রী। একটা সময় লাইবেরিয়ার অর্থমন্ত্রীও ছিলেন। তার পর গৃহযুদ্ধের আবর্তে তাঁকে জেলে যেতে হয়। এলেন দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে যোগ দেন বিশ্বব্যাঙ্কে। ২০০৩ সালে গৃহযুদ্ধ শেষে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হল। তার দু’বছরের মাথায় নির্বাচনে জিতে প্রেসিডেন্ট হলেন এলেন। সামনেই পরের নির্বাচন। এই মুহূর্তে এলেনের বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগও ধ্বনিত হচ্ছে লাইবেরিয়ায়। “এলেনকে আবার ভোট দেবেন কিনা, সেটা ও দেশের মানুষের নিজেদের ব্যাপার। তার সঙ্গে এই পুরস্কারের কোনও যোগ নেই,” বলেছেন ইয়াগলান্দ। এলেন নিজে একটা জিনিস চান আরও বেশি করে মেয়েরা রাজনীতিতে আসুন, ক্ষমতায় আসুন। “আফ্রিকা যেন আবার এক বার পুরুষদের ক্লাবে পরিণত না হয়!”
পুরুষদের যুদ্ধলিপ্সার বিরুদ্ধে মেয়েদের জড়ো করেই তো জোট বেঁধেছিলেন লেমা জিবোউয়ি। তখন তাঁর বয়স ৩০। ২০০২ সালে মুসলিম আর খ্রিস্টান মেয়েদের একসঙ্গে এনে গড়ে তুললেন ‘উইমেন ফর পিস’। তারা হাটে-বাজারে ঘুরে ঘুরে গান গাইত, মেয়েদের-শিশুদের রক্ষা করতে এগিয়ে আসত। অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচতে নির্ভয়ে ঘোষণা করতে পারত ‘যৌন হরতাল’ বা সহবাসে অসম্মতি।
সেই জিবোউয়ির কর্মকাণ্ড এখন ঘানা বা সিয়েরা লিওনের মতো দেশেও ছড়িয়ে গিয়েছে।
লাইবেরিয়াতে গণতন্ত্র ফিরিয়েছেন এলেন বা জিবোউয়ির মতো মেয়েরা। আরব দুনিয়াতে পরিবর্তন কত দূর এগোতে পারবে, সেটা বলার সময় আসেনি এখনও। ইয়েমেন তো এখনও পরিবর্তনের মুখ দেখেইনি। পরিবর্তনের দাবিতে সেই ফেব্রুয়ারি মাস থেকে ধর্নায় বসে রয়েছেন ৩২ বছরের তাওয়াকুল কারমান। তিন সন্তানের জননী। পেশায় সাংবাদিক। ‘উইমেন জার্নালিস্টস উইদাউট চেইনস’ নামে একটি মানবাধিকার সংগঠন গড়ে তুলেছেন কারমান। ইয়েমেনের শাসক সালেহ-র বিরুদ্ধে আন্দোলনের মুখ তিনিই।
এলেন-লেমা-তাওয়াকুল একত্রে যেমন শান্তি, গণতন্ত্র আর নারী আন্দোলনের তিন মুখ। নোবেল কমিটি এই তিন জনকে এক সূত্রে গেঁথে ‘গোটা বিশ্বের মেয়েদের প্রতি একটা গুরুত্বপূর্ণ বার্তা’ পৌঁছে দিতে চাইল। ২০১০-এ পুরস্কৃত হয়েছিলেন চিনের মানবাধিকার কর্মী লিউ জিয়াওবো। তুমুল প্রতিবাদে সরব হয়েছিল চিন। ২০০৯-এ নোবেল শান্তি ফলক তুলে দেওয়া হয় বারাক ওবামাকে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছিল শান্তির যে প্রতিশ্রুতি সঙ্গে নিয়ে ওবামার ঐতিহাসিক জয়, সেই প্রতিশ্রুতি কতটা রক্ষিত হয়, তা দেখার আগেই পুরস্কার কেন? এ বারে নোবেল কমিটির প্যানেলে ইয়াগলান্দের সঙ্গে আরও যে চার জন ছিলেন, তাঁরা মহিলা। গত এক বছরে কে কী করেছেন এবং আন্তর্জাতিক বিশ্বকে ইতিবাচক অগ্রগতির দিকে নিয়ে যেতে কার কী ভূমিকা, সেটাই বিচার্য থেকেছে বলে জানিয়েছেন ইয়াগলান্দ। “এই চয়ন হয়তো বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। কিন্তু আগের দু’বারের মতো তীব্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেবে না বলেই আমার বিশ্বাস”, বলেছেন তিনি। তিন কন্যাকে শান্তি পুরস্কার কি তবে নোবেল-সংসারেও শান্তি ফেরাবে?



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.

,