|
|
|
|
টের পাবে প্রতিষ্ঠাতার অভাব |
জোবস বিদায়ের পরেও ডুববে না অ্যাপল |
নিজস্ব প্রতিবেদন |
দুনিয়াকে চমকে দেওয়া নতুন আবিষ্কার হাতে আর কখনও মঞ্চে উঠবেন না স্টিভ জোবস। থাকবে না তাঁর জাদুকরী উদ্ভাবনী ক্ষমতা। ওই সম্মোহনী বিপণনেরও দেখা মিলবে না আর। কিন্তু ‘কোহিনূর’ হারানোর এই ধাক্কা সামলে অ্যাপল কি অ্যাপলই থাকবে? নাকি জোবসের অবর্তমানে নটে গাছটি মুড়োবে বিশ্বের সব থেকে দামি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার?
অর্থনীতিবিদ থেকে অ্যাপলের সাধারণ লগ্নিকারী। বাজার বিশেষজ্ঞ থেকে শিল্প মহলের প্রতিনিধি। এঁদের অধিকাংশের মতেই, জোবসের বিদায়ে এখনই একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়বে না সংস্থা। এমনও নয় যে, হঠাৎই বিক্রি বন্ধ হয়ে যাবে আই-ফোন বা আই-প্যাডের। কিন্তু প্রতি মুহূর্তে নিজেদের কিংবদন্তি প্রতিষ্ঠাতার অভাব অবশ্যই টের পাবে অ্যাপল। আগের মতো একই গতিতে নিত্যনতুন পণ্য বাজারে আনতে না পারলে, প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে ব্যবধানও কমে আসবে দ্রুত।
তামাম দুনিয়া মানছে যে, মেধা, পরিশ্রম, উদ্ভাবনী ক্ষমতা আর ক্যারিশমার অমন ককটেলের বিকল্প আর মিলবে না। হয়তো এই আশঙ্কাতেই শুক্রবার মার্কিন শেয়ার বাজার খোলার পরই সেখানে সংস্থার শেয়ার দর পড়েছে ৬ ডলারের বেশি। কিন্তু একই সঙ্গে অ্যাপল-প্রেমীদের আশা, নেতৃত্বের পরবর্তী প্রজন্মকে নিশ্চয়ই আগে থেকে নিজে হাতে গড়ে গিয়েছেন জোবস। তাঁর সময় যে ফুরিয়ে আসছে, তা আগেই আঁচ করেছিলেন সিলিকন ভ্যালির জাদুকর। তাই তার পরেও অ্যাপলের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করার কথা জোবসের মতো দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ ভাববেন না, তা অসম্ভব। |
|
নিউ টাউনের একটি অ্যাপল স্টোরে শ্রদ্ধার্ঘ্য। ছবি: অর্কপ্রভ ঘোষ। |
বিপণন বিশেষজ্ঞ শিলু চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, “আই-ফোন বা আই-প্যাড তো উনি একা তৈরি করেননি। বরং তিলে তিলে এমন সব উদ্ভাবনী যন্ত্র তৈরির সংস্কৃতি গড়েছেন সংস্থায়। তৈরি করেছেন প্রযুক্তিগত দক্ষতার গভীরতা।” তাই শুধুমাত্র জোবস চলে যাওয়ায় অ্যাপল মুখ থুবড়ে পড়বে বলে মনে করেন না তিনি।
অ্যাপলের শীর্ষে শক্তিশালী নেতৃত্বের কথা অস্বীকার করছেন না প্রায় কেউই। কিন্তু তবুও অন্তত একটি জায়গায় সামান্য হলেও ধন্দে পড়ছেন অনেকে। এঁদের মতে, এখন অ্যাপলের অস্তিনে লুকোনো রয়েছে আগামী দেড়-দু’বছর বাজারে আনার উপযুক্ত এক গুচ্ছ পণ্য। সংস্থার আর্থিক স্বাস্থ্য ভাল। শেয়ার দরও আকাশ ছোঁয়া। তাই জোবসের এই সাজানো বাগানে ফুল ফোটাতে এখনই হয়তো অসুবিধা হবে না সিইও টিম কুক ও তাঁর সঙ্গী-সাথীদের। কিন্তু শূন্য থেকে শুরু করে পাথর কুঁদে বাগান তৈরি? তা তো একমাত্র পারে জোবস-জাদু! সেই মশাল কার হাতে দিয়ে গেলেন অ্যাপলের কিংবদন্তি প্রতিষ্ঠাতা? এই সব বিশেষজ্ঞদের মতে, জোবস তো শুধু অ্যাপলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বা কর্ণধার ছিলেন না। বরং বরাবরই তিনি সংস্থার প্রাণ-ভোমরা। তাই তাঁর অনুপস্থিতিতেও হয়তো প্রাথমিক পতনের ধাক্কা সামলে বাড়বে অ্যাপলের শেয়ার দর। বাজারে আসবে নতুন পণ্য। কিন্তু বার বার টের পাওয়া যাবে সেই জাদুকরের অভাব। ক্রেতাদের ভবিষ্যৎ চাহিদার ‘ফর্দ’ অনেক আগেই নিখুঁত ভাবে পড়ে ফেলতেন যিনি। কিংবা স্রেফ উদ্ভাবনী ক্ষমতার জোরে তৈরি করতেন এমন সব পণ্য, যা নতুন করে তৈরি করত আস্ত বাজার। স্রেফ ‘নক-আউট’ হয়ে যেত প্রতিদ্বন্দ্বীরা।
আসলে জোবসের আস্ত জীবনটাই অসম্ভবকে সম্ভব করার গল্প। ছাই থেকে ফিনিক্স পাখির মতো ফিরে আসারও। বার বার। আর এই জিয়ন কাঠির ছোঁয়াতেই অ্যাপলের চাকা ঘুরিয়েছেন তিনি। প্রায় খাদের কিনারা থেকে টেনে তুলেছেন ডুবতে বসা অ্যাপলকে। সত্যি করেছেন শীর্ষে পৌঁছনোর রূপকথা। ‘ম্যাকিনটশ’ কম্পিউটার বাজারে এনে প্রাথমিক ভাবে সাফল্যের মুখ দেখলেও, আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই ধুঁকতে শুরু করে অ্যাপল। নব্বইয়ের দশকে দেখা দেয় অস্তিত্বের সঙ্কটও। সেই অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে শেয়ার দরের ভিত্তিতে হওয়া মূল্যায়ন অনুযায়ী বিশ্বের সব থেকে দামি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার সিংহাসন দখলের ‘স্পর্ধা’ দেখিয়েছে জোবসের অ্যাপল। পিছনে ফেলে দিয়েছে মাইক্রোসফট, ডেল, আইবিএমের মতো সংস্থাকেও।
কালো গোল গলা টি-শার্ট আর নীল জিন্স। এই ‘ট্রেড-মার্ক’ পোশাকে যখনই নতুন কোনও যন্ত্র হাতে মঞ্চে দাঁড়িয়েছেন জোবস, তখনই তাঁকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে স্বাগত জানিয়েছে দুনিয়া। জেনেছে, জোবস মানেই জাদু। তা সে উন্নত প্রযুক্তির ম্যাক কম্পিউটার হোক বা গান শোনার ধারণা বদলে দেওয়া আই-পড। কিংবা ফোনে কথা বলার সংজ্ঞা বদলে দেওয়া আই-ফোন। হু হু করে বাজারে বিকোচ্ছে ফোন-ল্যাপটপের যুগলবন্দি আই-প্যাড। যে পণ্যই বাজারে এনেছেন, তা বিস্মিত-আলোকিত-শিহরিত, করেছে সকলকে।
আর এই সব ক্ষেত্রেই সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা জোবসের ভাবনা, বাজারকে আগাম পড়ে ফেলার অত্যাশ্চর্য ক্ষমতা চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছে সকলের। একই সঙ্গে মন্ত্রমুগ্ধ করে দিয়েছে তাঁর জাদুকরী বিপণন। বাজারে কোনও পণ্য আনার আগে তা নিয়ে চূড়ান্ত রহস্য তৈরির ক্ষমতা। মঞ্চে নতুন যন্ত্রের গুণাগুণ বোঝাতে গিয়ে শিশুর উচ্ছ্বাস। চোখধাঁধানো ‘ক্যারিশমা’। আর প্রতিদ্বন্দ্বীদের স্রেফ উড়িয়ে দেওয়া তুরীয় মেজাজ। এই সব কিছুর যোগফল হিসেবে প্রায় প্রতি বারই আত্মপ্রকাশের দিনই বক্স-অফিস জিতে নিয়েছে জোবসের যন্ত্র। আর এর বিকল্প হয় না বলেই জোবস সুস্থ থাকতে যে কোনও নতুন যন্ত্র আনার মাহেন্দ্রক্ষণেই তাঁকেই মঞ্চে তুলেছে অ্যাপল। তাঁর অসুস্থতায় উথাল-পাতাল হয়েছে শেয়ার বাজার। সিইও হিসেবে তাঁর উত্তরসূরী টিম কুককে অশ্রদ্ধা না-করেও বাজার মনে করেছে, ‘‘আর যাই হোক, কুক অন্তত জোবস নন।” যে ধারণা আরও জোরালো হয়েছে আই ফোন-ফোর এসের বাজারে আনার ঘোষণার পর।
চরিত্র হিসেবে জোবস এবং কুকের ততটাই অমিল, যতখানি হওয়া সম্ভব। এক দিকে জোবস। যিনি অবিশ্বাস্য প্রতিভাধর। কিন্তু একই সঙ্গে খামখেয়ালি। ব্যবসার ব্যাকরণ মেনে চলার থেকে চিন্তার স্বকীয়তার উপরেই বেশি ভরসা করতেন যিনি। কুক মিতবাক, শান্ত-শিষ্ট, আপাদমস্তক ভদ্রলোক। মস্তিষ্ক ক্ষুরধার। কিন্তু রুটিন মেনে সব নিখুঁত ভাবে পরিচালনাতেই তিনি স্বচ্ছন্দ। তাই অনেকেরই প্রশ্ন, সংস্থা পরিচালনার কাজ হয়তো দক্ষতার সঙ্গেই সামলাবেন কুক। কিন্তু পণ্য ডিজাইনে ‘পাগলাটে’ জোবসের অভিনবত্ব তিনি আমদানি করবেন কী ভাবে? সম্ভবত এই সব কারণেই জোবসের অভাব এত বেশি করে অনুভব করছেন অ্যাপলের লগ্নিকারীরা। তাঁদের একটি বড় অংশ মনে করেন, ‘অ্যান্ড্রয়েড’ প্রযুক্তি নিয়ে ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে গুগ্ল। বাজারে একের পর ‘টাচ স্ক্রিন’ মোবাইল বা আই-প্যাড ঘরানার পণ্য আনছে স্যামসাং। আর সিংহাসন ফিরে পেতে নতুন করে ঝাঁপাচ্ছে মাইক্রোসফট। এই পরিস্থিতিতেই তো অ্যাপলের সব থেকে বেশি করে প্রয়োজন ছিল তাঁকে। মঞ্চে। দুনিয়াকে চমকে দেওয়া নতুন আবিষ্কার হাতে।
আর ঠিক এখানেই মৃত্যুর পরেও প্রসঙ্গিক হয়ে থাকছেন জোবস। কারণ, তীব্র প্রতিযোগিতায় যুঝে শীর্ষে টিকে থাকতে সেই জোবসেরই বাছাই করা ‘টিম’ আর সংস্থার প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে দেওয়া উদ্ভাবনের নেশার উপর আস্থা রাখছে অ্যাপল। |
বিদায় জোবস |
কী বলছে কলকাতা |
• এই শহরে যাঁরা নতুন প্রজন্ম, যাঁদের হাতে অত্যাধুনিক যন্ত্র, তাঁরা কী ভাবে দেখছেন জোবসের সৃষ্টিকে |
• শবনম বন্দ্যোপাধ্যায় (২০), কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী: অ্যাপল নামটা শোনা। এখন নিজে টাচ ফোনই ব্যবহার করি। মোবাইলেই নেট সার্ফিং, ফেসবুক চটজলদি সেরে ফেলি। তবে আই ফোন কেনার সামর্থ্য নেই। ইচ্ছে থাকল। চাকরি পেয়ে যদি কিনতে পারি। ব্র্যান্ডের পিছনে ছুটি না। |
• দেবজ্যোতি বিশ্বাস (২৭), তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী: আড়াই মাস আগে আমেরিকায় গিয়ে আই ফোন কিনেছি। অ্যাপলের ব্র্যান্ড ভ্যালুর সঙ্গে দেখনদারিও কেনার কারণ। অন্য যে কোনও টাচ ফোনের থেকে অনেক তাড়াতাড়ি কাজ করা যায় আই ফোনে। |
• সুমিত চৌধুরী (২৪), চলচ্চিত্র নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত: অ্যাপলের ল্যাপটপ ব্যবহার করি। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও দামের জন্যই কেনা হয়নি আইফোন। |
• রোশনী নিয়োগী (২১), যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের চতুর্থ
বর্ষের ছাত্রী: টাচ ফোন
ব্যবহার করি। ৬-৭ হাজার টাকার মোবাইল সেট
কিনতে পারি। কিন্তু ৩০-৩৫ হাজার টাকার আই ফোন
কেনা সম্ভব নয়। |
|
|
|
|
|
|