|
|
|
|
সময় সীমিত,
নিজের
জীবনটা বাঁচো |
|
|
তোমরা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিদ্যা অর্জন করে কর্মজীবনে প্রবেশ করছ। আজ তোমাদের সঙ্গে এখানে থাকতে পেরে আমি সম্মানিত বোধ করছি। আমি কখনও কলেজ থেকে পাশ করিনি। সত্যি বলতে কী, আজ আমি গ্র্যাজুয়েট হওয়ার যতটা কাছাকাছি এসেছি, আগে কখনও তা আসেনি। আমি আজ তোমাদের তিনটে গল্প বলব। আমার জীবনের গল্প। ব্যস, এইটুকুই। স্রেফ তিনটে গল্প।
প্রথম গল্পটা হল কয়েকটা বিন্দু যোগ করার গল্প।
আমি রিড কলেজে ছ’মাস পড়ে পড়া ছেড়ে দিয়েছিলাম। তার পর আরও আঠারো মাস মাঝে মধ্যে ক্লাসে যেতাম। তার পর একেবারেই কলেজ ছেড়ে দিলাম। প্রশ্ন হল, কেন আমি কলেজ ছাড়লাম?
আসলে ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল আমার জন্মের আগেই। আমার জন্মদায়িনী মা ছিলেন অবিবাহিতা, কলেজের ছাত্রী। তিনি ঠিক করেছিলেন, আমি জন্মালে আমায় দত্তক দেবেন। তাঁর খুব ইচ্ছে ছিল, যাঁরা আমাকে দত্তক নেবেন, তাঁরা যেন কলেজ গ্র্যাজুয়েট হন। অতএব স্থির হল, এক উকিল এবং তাঁর স্ত্রী আইনত আমার বাবা-মা হবেন। সেই অনুযায়ী সব বন্দোবস্ত হল। কেবল একটা ছোট্ট গোলমাল হয়ে গেল। আমি যখন জন্মালাম, তখন, একেবারে শেষ মুহূর্তে, তাঁরা ঠিক করলেন যে তাঁরা একটি মেয়েকে দত্তক নিতে চান। অতএব ওয়েটিং লিস্টে প্রথম দম্পতির কাছে মধ্য রাত্রে ফোন গেল, “আমাদের কাছে একটি অপ্রত্যাশিত নবজাতক এসেছে, একটি ছেলে, আপনারা কি তাকে দত্তক নিতে চান?” তাঁরা বললেন, “অবশ্যই।”
দত্তক নেওয়ার চূড়ান্ত নথিপত্র সই করার আগে আমার গর্ভধারিণী জানতে পারলেন যে, যিনি আমার মা হবেন তিনি কলেজ পাশ করেননি, আর আমার পালক বাবা হাইস্কুলের গণ্ডিও পেরোননি। এই শুনে আমার জননী তো বেঁকে বসলেন, বললেন, কিছুতেই এদের হাতে ছেলেকে দেব না। শেষ পর্যন্ত ওঁরা দুজন কথা দিলেন, আমাকে কলেজে পড়াবেনই। কয়েক মাস পর, মা রাজি হলেন।
পনেরো বছর পরে আমি সত্যিই কলেজে গেলাম। কিন্তু বোকার মতো এমন একটা কলেজ বাছলাম, যেখানে পড়াশোনার খরচ প্রায় স্ট্যানফোর্ডের সমান। আমার মা-বাবা অনেক কষ্ট করে যা টাকা জমিয়ে ছিলেন, আমার লেখাপড়ার পিছনে ঢালতে শুরু করলেন। অথচ, আমি নিজের জীবন নিয়ে কী করব, আর কলেজের পড়া তাতে আমার কী কাজে লাগবে, সেটা আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। সুতরাং ছ’মাস পরই আমি ঠিক করলাম, আর নয়। তখন এই ভাবে কোর্স ছেড়ে দিয়ে খুব ভয় লেগেছিল, কিন্তু এখন মনে হয়, সেটাই ছিল আমার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সিদ্ধান্ত। কোর্স ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা বিরাট সুবিধে হল। যে ক্লাসগুলো আমার ভাল লাগত না, সেগুলোতে যাওয়া বন্ধ করলাম, আর ভাল লাগে এমন কিছু ক্লাসে যেতে শুরু করলাম।
সবটাই খুব রোমান্টিক ছিল না। ইউনিভার্সিটিতে আমার নিজের থাকার আর কোনও জায়গা নেই, বন্ধুর ঘরে মেঝেতে শুতাম। কোক-এর বোতল ফেরত দিলে পাঁচ সেন্ট ফেরত পাওয়া যেত, সেটা জমিয়ে রাখতাম খাবার কেনার জন্য। প্রত্যেক রবিবার রাত্রে সাত মাইল হেঁটে হরেকৃষ্ণ মন্দিরে যেতাম, কারণ বিনা পয়সায় ভাল খাবার দিত ওখানে, জমিয়ে খেতাম। এবং স্রেফ কৌতূহল আর ধারণার বশে কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, যেগুলো পরবর্তী জীবনে অমূল্য বলে প্রমাণিত হয়েছিল। একটা উদাহরণ দিই।
সেই সময়ে রিড কলেজে ক্যালিগ্রাফির যে কোর্সটা দেওয়া হত, গোটা আমেরিকায় সম্ভবত তার কোনও তুলনা ছিল না। এর পরিচয় মিলত কলেজের ক্যাম্পাসেও। প্রতিটি পোস্টার থেকে শুরু করে প্রত্যেক ড্রয়ারের লেবেল পর্যন্ত সব কিছু অপূর্ব সব হস্তাক্ষরে লেখা হত। আমি তো নিজের কোর্স ছেড়ে দিয়েছি, হাতে অনেক সময়, ঠিক করলাম, ক্যালিগ্রাফি শিখব। হরফের রহস্য শিখলাম, হরফের মধ্যে শূন্যস্থান অদল-বদল করে বিভিন্ন ভাবে সাজানোর পাঠ নিলাম, বুঝলাম কী ভাবে টাইপোগ্রাফি অসামান্য হয়ে ওঠে। এই বিদ্যাটির মধ্যে নিহিত আছে ইতিহাস, শিল্প আর নন্দনবোধ। এটা কেবল বিজ্ঞান দিয়ে ধরা যায় না।
এর কিছুই যে পরবর্তী জীবনে আমার কোনও কাজে লাগতে পারে, তখন সে কথা ভাবার কোনও কারণ ছিল না। কিন্তু এর দশ বছর পরে যখন আমরা প্রথম ম্যাকিনটশ কম্পিউটার ডিজাইন করছিলাম, তখন এই শিক্ষাগুলো সব ফিরে এল। এবং আমরা ম্যাক-এর ডিজাইনটাকে সেই ভাবে তৈরি করলাম। এত সুন্দর টাইপোগ্রাফি আগে কোনও কম্পিউটারে ছিল না। রিড কলেজে ওই খেয়ালের বশে বেছে নেওয়া টাইপোগ্রাফির কোর্সে যদি ভর্তি না হতাম, ম্যাক-এর এত রকমারি হরফও তৈরি হত না, তার এমন সুবিন্যস্ত হরফও থাকত না। আর উইন্ডোজ যেহেতু স্রেফ ম্যাক-এ হরফগুলো টুকে দিয়েছিল, সুতরাং ম্যাক-এর হরফ এত সুন্দর না হলে কোনও পার্সোনাল কম্পিউটারে তা থাকত না। অর্থাৎ, আমি যদি আমার নির্ধারিত কোর্স ছেড়ে দিয়ে ক্যালিগ্রাফির কোর্সে না ঢুকতাম, তা হলে কোনও পি সি-তে সুন্দর অক্ষর থাকত না। একেই আমি বলছি একটা বিন্দুর সঙ্গে আরেকটা বিন্দু যোগ করা।
অবশ্যই যখন কলেজে পড়ি, তখন সামনের জীবনের কথা ভেবে বিন্দুগুলো জোড়ার কোনও প্রশ্নই ছিল না। ভবিষ্যতের যোগসূত্রগুলো আগাম চেনা যায় না।
কিন্তু পরে, পিছন ফিরে তাকিয়ে সেটা খুব ভাল বোঝা যায়।
তাই আজ তোমরাও জানবে না, কী ভাবে জীবনের বিন্দুগুলো যোগ করা যাবে। কিন্তু নিজের মধ্যে একটা না একটা বিশ্বাস রাখতে হবে। মনের জোর, নিয়তি, জীবন, কর্মকিছু না কিছু। যদি তা পারো, তা হলে ওই বিন্দুগুলো যুক্ত হবেই। আমি সারা জীবন এটা করেছি এবং কখনও ব্যর্থ হইনি। এটাই আমার জীবনকে পাল্টে দিয়েছে।
আমার দ্বিতীয় গল্পটা হল ভালবাসা এবং হারানো নিয়ে।
আমি সৌভাগ্যবান। আমি যা করতে ভালবাসি, কম বয়সেই তার সন্ধান পেয়েছিলাম। ওজ আর আমি যখন আমার বাবা-মার গ্যারাজে অ্যাপল-এর উদ্যোগ শুরু করলাম, আমার বয়স কুড়ি। আমরা খুব পরিশ্রম করলাম, এবং দশ বছরের মধ্যে সেই গ্যারেজে শুরুকরা অ্যাপল পরিণত হল একটি ২০০ কোটি ডলারের কোম্পানিতে, যেখানে ৪ হাজারের বেশি কর্মী কাজ করেন।
আমি তখন সবে ৩০ পেরিয়েছি। ঠিক আগের বছর আমরা আমাদের সবচেয়ে চমৎকার সৃষ্টিটি বাজারে ছেড়েছি ম্যাকিনটশ। আমার চাকরি গেল। যে কোম্পানি তুমি-ই শুরু করেছিলে, সেখান থেকে কী করে তোমার চাকরি যায়? আসলে অ্যাপল যখন অনেক বড় কোম্পানি হয়ে উঠছিল, তখন আমরা এক জনকে তার দায়িত্ব দিলাম। ভেবেছিলাম, তাঁর দারুণ ট্যালেন্ট, আমার সঙ্গে দারুণ কাজ করবেন। প্রথমটায় ভালই চলছিল। কিন্তু তার পর ক্রমশ ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমাদের দু’জনের ধারণাগুলো একে অন্যের থেকে আলাদা হতে শুরু করল, শেষ পযর্ন্ত সেই মত পার্থক্য একটা চরম আকার ধারণ করল। যখন সেটা ঘটল, তখন আমাদের বোর্ড অফ ডিরেক্টরস আমার বিরুদ্ধে গেলেন। অতএব ৩০ বছর বয়েসে আমাকে আমার কোম্পানি থেকে বের করে দেওয়া হল। এবং একেবারে প্রকাশ্যে। বড় হওয়ার পর থেকে যা ছিল আমার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য, সেটাই হারিয়ে গেল। আমার পক্ষে একটা মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা।
প্রথম কয়েক মাস বুঝতে পারছিলাম না, কী করা উচিত। আমার মনে হচ্ছিল, আগের প্রজন্মের যে উদ্যোগীরা আমার হাতে রিলে রেসের ব্যাটনটা তুলে দিয়েছিলেন, আমি তাঁদের ডুবিয়েছি। আমি কম্পিউটার জগতে দুই দিকপাল, ডেভিড প্যাকার্ড এবং বব নয়েস-এর সঙ্গে দেখা করে ক্ষমা চাইবার চেষ্টা করলাম, বললাম যে আমি ভয়াবহ ভাবে সব গোলমাল করে ফেলেছি। আমি একেবারে হাটের মাঝে ব্যর্থ প্রমাণিত হলাম। আমি এমনকী সিলিকন ভ্যালি ছেড়ে চলে যাওয়ার কথাও ভেবেছিলাম। কিন্তু আস্তে আস্তে একটা সত্য আমি উপলব্ধি করছিলাম। সেটা এই যে, আমি আমার কাজটা একই রকম ভালবাসি, সেটা একটুও কমেনি, অ্যাপল-এর ঘটনা সেখানে কোনও পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি। আমি প্রত্যাখ্যাত হয়েছি, কিন্তু আমার ভালবাসা অটুট আছে। অতএব ঠিক করলাম, নতুন করে শুরু করব।
তখন বুঝিনি, কিন্তু পরবর্তী ইতিহাস প্রমাণ করেছে যে, অ্যাপল থেকে সরে যেতে বাধ্য হওয়াটা ছিল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ ঘটনা। সাফল্য আমার কাঁধে একটা বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তার বদলে এখন আমি আবার সব কিছু নতুন করে শুরু করছি, খুব হাল্কা লাগলমুক্তির নির্ভার অনুভূতি। এখন আর কিছুই নিশ্চিত নয়, সব কিছুই নতুন করে খুঁজতে পারি, যাচাই করতে পারি। এই মুক্তিই আমাকে আমার জীবনে এক অসামান্য সৃষ্টিশীল পর্বে প্রবেশ করিয়ে দিল।
এর পরের পাঁচ বছরে আমি প্রথমে নেক্সট, তার পর পিক্সার নামে দু’টি কোম্পানি গড়ে তুললাম এবং এক আশ্চর্য নারীর প্রেমে পড়লাম, যে পরে আমার স্ত্রী হবে। পিক্সার এখন দুনিয়ার সবচেয়ে সফল অ্যানিমেশন স্টুডিও, কম্পিউটার অ্যানিমেশনের ভিত্তিতে প্রথম চলচ্চিত্র ‘টয় স্টোরি’ পিক্সারেরই তৈরি। তার পর, ইতিহাস সত্যিই এক আশ্চর্য ব্যাপার, অ্যাপল নেক্সট-কে কিনে নিল, আমি অ্যাপল-এ ফিরে এলাম এবং নেক্সট-এ যে প্রযুক্তি আমরা উদ্ভাবন করেছিলাম, সেটাই অ্যাপল-এর পুনরুত্থানের চাবিকাঠি। এবং, লরেন আর আমি দারুণ সংসার করছি।
আমি নিশ্চিত, অ্যাপল থেকে আমাকে সরিয়ে দেওয়া না হলে এ সব কিছুই ঘটত না। ওষুধটা খেতে ভয়ানক খারাপ ছিল, কিন্তু রোগীর ওষুধটা দরকার ছিল। কখনও কখনও জীবন তোমার মাথায় একটা থান ইটের মতো আঘাত করবে। বিশ্বাস হারিও না। একটা ব্যাপারে আমার কোনও সংশয় নেই। একটি সত্যই আমাকে চালিয়ে নিয়ে গিয়েছে, সেটা এই যে আমি যা করছিলাম, তা ছিল আমার প্রিয় কাজ।
তোমাদের খুঁজে নিতে হবে তোমরা কী ভালবাস। খুঁজে নিতেই হবে। এটা ভালবাসার মানুষটিকে খুঁজে নেওয়ার ক্ষেত্রে যতটা সত্যি, কাজের ক্ষেত্রেও ততটাই। কাজ তোমাদের জীবনের একটা বড় অংশ জুড়েই থাকবে, তাই সত্যিকারের সন্তুষ্টি যদি চাও, তবে সেই কাজেই মনপ্রাণ ঢেলে দাও, যা তুমি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করো। তা হলেই জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারবে। যদি সেই কাজের সন্ধান এখনও না পেয়ে থাকো, তবে সেটা খুঁজে চলো। বসে পরো না, থেমে যেও না। যখন খুঁজে পাবে, নিজেই উপলব্ধি করবে যে, পেয়েছ। এটা হৃদয় সম্পর্কিত যে কোনও বিষয়েই সত্য। যেমন ভালবাসায়, তেমনই কাজে। এবং যে কোনও সম্পর্কের মতোই, যত সময় যায়, ঠিক ঠিক মানুষ কিংবা ঠিক ঠিক কাজ খুঁজে পাওয়ার প্রক্রিয়াটা ক্রমশই আরও ভাল হতে থাকে।
সুতরাং, যত দিন নিজের পছন্দের পথটা খুঁজে না পাও, সন্ধান চালিয়ে যাও। যা চাও, সেটা তখন না পাও, খুঁজতে থাক। সন্তুষ্ট হয়ে থেমে যেও না।
আমার তিন নম্বর গল্পটা মৃত্যু নিয়ে। আমার বয়স যখন ১৭, আমি কারও একটা কথা পড়েছিলাম, যার বক্তব্য মোটামুটি এই রকম: “যদি তুমি প্রত্যেকটা দিন এমন ভাবে বাঁচতে পারো, যেন সেটাই তোমার জীবনের শেষ দিন, তা হলে এক দিন না এক দিন তোমার জীবনের হিসেব মিলবেই মিলবে।” কথাটা আমার মনে গভীর দাগ কেটেছিল। গত ৩৩ বছর ধরে প্রতিদিন সকালে আমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রশ্ন করেছি, “আজ যদি আমার জীবনে শেষ দিন হত, তা হলেও কি আমি যা করতে চলেছি তাই করতাম?” যখন অনেক দিন একটানা এই প্রশ্নের উত্তর পেয়েছি‘না’, তখনই আমি জেনেছি যে, যা করছি, সেটা ঠিক নয়, কোথাও কিছু একটা বদলানো দরকার।
আমি আর বেশি দিন নেইএটা মনে রাখাই আমার জীবনের বড় সিদ্ধান্তগুলো নেওয়ার পথে আমার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। তার কারণ, মৃত্যুর সামনে সব কিছু হার মেনে যায়বাইরের সব প্রত্যাশা, সব অহংকার, সব লজ্জা, ব্যর্থতার সব আশঙ্কা, সব কিছু। থেকে যায় শুধু সেটাই, যা সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
যদি মনে রাখতে পার যে, মৃত্যু অনিবার্য, তা হলে আর কিছু হারাবার ভয় থাকে না। তখন তুমি জানো যে তোমার আর কোনও আবরণ নেই, কোনও পিছুটান নেই। তখন নিজের মনের দাবি মেটানোর জন্য সব কিছু দিতে পার।
বছর খানেক আগে আমার ক্যানসার ধরা পড়েছে। সে দিন সকাল সাড়ে সাতটায় একটা স্ক্যান করানো হয়, এবং তাতে এটা পরিষ্কার দেখা যায় যে আমার প্যানক্রিয়াসে একটা টিউমার রয়েছে। প্যানক্রিয়াস কী, আমি সেটাই জানতাম না। ডাক্তার আমাকে তখনই জানালেন যে, এটা প্রায় নিশ্চিত যে আমার ক্যানসার হয়েছে, এবং সেটা সারানো যাবে না, এবং আমার আয়ু তিন থেকে ছ’মাস। তিনি আমাকে পরামর্শ দিলেন, আমি যেন বাড়ি গিয়ে সব কিছু গুছিয়ে ফেলি। ডাক্তাররা যখন এটা বলেন, তখন আসলে তাঁরা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হতে বলেন। তার মানে, আগামী দশ বছরে ছেলেমেয়েদের যা বলবে ভেবেছিলে, সেটা কয়েক মাসের মধ্যে বলে ফেলার চেষ্টা। তার মানে, সব কিছু এমন পরিপাটি করে গুছিয়ে ফেলা, যাতে পরিবারের কোনও সমস্যা না হয়। তার মানে, যাকে যাকে ‘বিদায়’ জানানোর আছে, জানিয়ে দেওয়া।
তো, ডায়াগনসিস জানার পর সারা দিনটা কাটল। সন্ধেবেলায় এন্ডোস্কোপের সাহায্যে আমার প্যানক্রিয়াসে টিউমার থেকে কয়েকটা সেল নিয়ে একটা বায়োপ্সি করা হল। আমাকে অচেতন করেই সেটা করা হয়েছিল, কিন্তু আমার স্ত্রীর কাছে পরে শুনেছি, বায়োপ্সির রিপোর্ট দেখে ডাক্তার কেঁদে ফেলেছিলেন। কারণ সেলগুলি মাইক্রোস্কোপের নীচে রেখে বিশ্লেষণ করে ডাক্তাররা বুঝতে পারেন যে, আমার ক্যানসারটা খুব বিরল প্রজাতির, এবং সেটা সার্জারির সাহায্যে সারানো যায়! আমার সার্জারি হয়। আমি ভাল আছি।
মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়ানো বলতে যা বোঝায়, আমার জীবনে এটাই তার সবচেয়ে কাছাকাছি অভিজ্ঞতা, এবং আমি আশা করব, আরও কয়েকটা দশক সেটাই থাকবে। এই অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গিয়েছি বলে আমি তোমাদের কয়েকটা কথা একটু জোরের সঙ্গে বলতে পারি। এর আগে আমার কাছে মৃত্যু ছিল একটি প্রয়োজনীয় ধারণা, কিন্তু ধারণা মাত্র। আজ আমার সেই ধারণাটা আর একটু প্রত্যক্ষ, তাই কথাগুলো আর একটু নিশ্চয়তার সঙ্গে বলতে পারছি।
কেউ মরতে চায় না। যাঁরা স্বর্গে যেতে চান, তাঁরাও সে জন্য মরতে চান না। অথচ মৃত্যু আমাদের সকলের ভবিতব্য। কেউ তার হাত থেকে পরিত্রাণ পায়নি। এবং সেটাই হওয়ার কথা। কারণ মৃত্যুই হল জীবনের শ্রেষ্ঠ ইনভেনশন, অর্থাৎ উদ্ভাবন। মৃত্যুই জীবনের ‘চেঞ্জ এজেন্ট’পরিবর্তনের কারিগর। মৃত্যু পুরনোকে সরিয়ে দিয়ে নতুনের জন্য জায়গা করে দেয়। এই মুহূর্তে তোমরা নতুন, কিন্তু এক দিন, সে দিন আজ থেকে খুব দূরে নয়, তোমরা ধীরে ধীরে পুরনো হয়ে যাবে, তোমাদের সরে যেতে হবে। একটু বেশি নাটকীয় ভাবে বললাম, কিন্তু কথাটা সত্য।
জীবনে সময় সীমিত, তাই অন্য কারও মতো জীবন কাটিয়ে সময় নষ্ট করো না, নিজের জীবনটা বাঁচো। কোনও ধরা বাঁধা ধারণা বা বিশ্বাসের কাছে নিজেকে সমর্পণ কোরো না, কারণ সেগুলো অন্যের চিন্তা-ভাবনার ফল। অন্যের মতামতের কোলাহলে নিজের অন্তরের কণ্ঠস্বরকে হারিয়ে যেতে দিও না। এবং, সবচেয়ে বড় কথা, নিজের হৃদয় এবং অন্তর্দৃষ্টিকে অনুসরণ করার সাহস রাখো। তোমার নিজের ভেতরে তুমি কোনও না কোনও ভাবে জানো, তুমি সত্যিই কী করতে চাও। সেটাই আসল কথা, বাকি সব কিছুই গৌণ।
আমরা যখন তরুণ ছিলাম, তখন একটা আশ্চর্য জিনিস পাওয়া যেত, তার নাম ‘দ্য হোল আর্থ ক্যাটালগ’। আমাদের বয়সীদের কাছে এটা ছিল একটা বাইবেলের মতো। এটা তৈরি করেছিলেন স্টুয়ার্ট ব্র্যান্ড। তিনি থাকতেন কাছেই, মেনলো পার্কে। এই প্রকাশনাটিতে তাঁর কবি মনের একটা স্পর্শ ছিল। সেটা ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকের কথা। তখনও পার্সোনাল কম্পিউটার, ডেস্কটপ প্রকাশনার যুগ শুরু হয়নি, এই ক্যাটালগটি তৈরি হত টাইপরাইটার, কাঁচি এবং পোলারয়েড ক্যামেরা দিয়ে। এক অর্থে এটা ছিল পেপার ব্যাকে গুগল-এর মতো। এবং গুগল আসার ৩৫ বছর আগে। অনেক স্বপ্ন নিহিত ছিল এই ক্যাটালগটিতে, চমৎকার সব ধারণা এবং প্রকরণও।
স্টুয়ার্ট ও তাঁর সঙ্গীরা ‘দ্য হোল আর্থ ক্যাটালগ’-এর কয়েকটি সংখ্যা তৈরি করেছিলেন, তার পর এক দিন এর দিন ফুরলো, ওঁরা শেষ সংখ্যাটি প্রকাশ করলেন। সেটা ৭০-এর দশকের মাঝামাঝি, আমার বয়স তখন তোমাদের মতো। সেই শেষ সংখ্যার পিছনের প্রচ্ছদে একটি ফটোগ্রাফ ছিল। ভোরবেলা, শহর থেকে দূরে একটা নির্জন পথ, যারা একা একা অনেক দূরে বেরিয়ে পড়তে ভালবাস, তারা যেমনটি খুব চেনো। ছবির নীচে লেখা: “স্টে হাংগ্রি। স্টে ফুলিশ।’’ ওটাই ছিল স্টুয়ার্ট ব্র্যান্ডদের বিদায় বার্তা। ভিতরের খিদেটা হারিও না। হিসেবি হয়ো না। আমি বরাবর নিজে এ রকমটাই থাকতে চেয়েছি। তোমরা এখন গ্র্যাজুয়েট হয়ে নতুন জীবন শুরু করছ, আমি কামনা করি, তোমরা সেটাই মেনে চলো।
স্টে হাংগ্রি, স্টে ফুলিশ।
|
(২০০৫ সালে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে স্টিভ জোবসের বক্তৃতা) |
|
|
|
|
|