|
|
|
|
স্টিভন পল জোবস
(১৯৫৫-২০১১) |
|
|
তাঁর পরিচয়টি সংক্ষিপ্ত। ছোট হাতের একটি রোমান ‘আই’ অক্ষর। তিনি খানদানি নৃপতি নন, সিনে-দুনিয়ার তারকাও নন। অথচ, এই গ্রহ আজ তাঁর সামনে নতজানু। শোকবার্তার ঢেউ উঠেছে সর্বত্র। ওবামা থেকে ব্লেয়ার, মাইক্রোসফট থেকে গুগল, সন্তাপে মিলে যাচ্ছে সবাই। একটি ছোট হাতের ‘আই’ ক্রমেই আকাশ ছুঁয়ে ফেলছে।
সেই ‘আই’, কিংবা ভাষান্তরে বলা যায়, সেই ‘আমি’, অর্থাৎ স্টিভন পল জোবস, নামসংক্ষেপে স্টিভ জোবস, মারণ রোগের সঙ্গে চূড়ান্ত মোকাবিলায় শেষ পর্যন্ত জিতে গেলেন।
সেই জয়ের নাম মৃত্যু। খুব নিজস্ব ভঙ্গিতে বরণ করে নেওয়া মৃত্যু।
জীবনের শেষ কয়েকটি সপ্তাহ বেছে নিলেন একান্ত নির্বাসন, প্রিয়তম স্বজনদের সঙ্গে। চোখের সামনে থাকলেন তাঁরাই, যাঁদের তিনি দেখতে চেয়েছিলেন অন্তিম মুহূর্তে। তা বলে, ‘অ্যাপল’-ও দূরে রইল না। নির্দেশ গেল, কী ভাবে আত্মপ্রকাশ করবে আইফোন ফোর এস।
অতঃপর, শেষ বিদায়।
গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের জাদু-বাস্তব ধাঁচে বলা চলে, একটি অবধারিত মৃত্যুর ধারাবিবরণী। অগ্ন্যাশয়ের কর্কট রোগ ছিলই ভিতরে, ধীরে শিকড় ছড়িয়েছে শরীরের অন্য নানা ভাগে, কিন্তু স্টিভন পল জোবস বারংবার, তিলে তিলে মরেননি। শেষ বারের মতো চক্ষু বোজার আগে মেনে নিতে চাননি যে, মৃত্যুর ওই ঘনিয়ে-আসা ছায়াটুকুই কেড়ে নিতে পারে জীবনের আরও নানা কারুকার্য। বাধা আসবেই, যেমন আসে। আবার, জীবনও এগোবেই, যেমন এগোয়, এবং শুধু এগোবে, তা-ই নয়, জিতবেও।
বাধার সঙ্গে লড়াই করে চূড়ান্ত এই জয়ের আখ্যানই আসলে নির্ভুল মার্কিন স্বপ্ন। ‘দ্য গ্রেট আমেরিকান ড্রিম’! দু’হাজার এগারো খ্রিস্টাব্দের পাঁচ অক্টোবর একটি কিংবদন্তী জীবনের অন্তিমে সেই স্বপ্নের বৃহত্তম প্রতীক হয়ে উঠলেন স্টিভন পল জোবস।
শুধু কিংবদন্তী-ই নয়, উত্থান-পতনের তুমুল বিস্তারে সেই জীবন মহাকাব্যিকও বটে। সেই মহাকাব্য যা মানুষকে নিক্ষেপ করে পাশাপাশি প্রখর আলো এবং নিকষ আঁধারে। প্রতিতুলনায় আর এক মহাকাব্যিক চরিত্রের কথা আসতেই পারে। সেই চরিত্র যিনি নিজস্ব পুরুষকারের শৌর্য ত্যাগ করেননি কোনও দিন, সগর্বে বলেছিলেন, ‘দৈবায়ত্তং কুলে জন্ম, মদায়ত্তং তু পৌরুষম্’।
কর্ণ। |
১৯৭৬ |
১৯৭৭
অ্যাপল ২
|
জোবস জাদু
|
|
১৯৭৮
নতুন লোগো |
১৯৮০
অ্যাপল শেয়ারবাজারে।
কোটিপতি স্টিভ। দু’ বছর
পরে অ্যাপল-এর বিক্রি
১০০ কোটি ডলার ছাড়াল |
স্টিভ ওজনিয়াককে
নিয়ে
সিলিকন ভ্যালির
গ্যারাজে
শুরু
অ্যাপল।
প্রথম কম্পিউটার
বিক্রি ওই বছরেই |
১৯৮৪
ম্যাকিনটশ |
১৯৮৫
সিইও-র সঙ্গে
মতভেদ।
অ্যাপল থেকে
বিদায় স্টিভের |
১৯৮৬
নতুন সংস্থা নেক্সট
খুললেন
স্টিভ। তিন
বছর পরে তাদের
প্রথম
কম্পিউটার বাজারে |
১৯৮৭
নিউটন |
১৯৯৬
নেক্সট কিনে
নিল
অ্যাপল,
উপদেষ্টা
হয়ে
ফিরলেন স্টিভ |
১৯৯৮
আইম্যাকের আত্মপ্রকাশ।
দু’বছর পরে অ্যাপল-এর
সিইও স্টিভ |
২০০১
আনলেন আইপড, বদলে
গেল গান শোনার দুনিয়া |
২০০৭
এল আইফোন |
|
২০১০
স্টিভ জাদু আবার।
আইপ্যাডের আত্মপ্রকাশ |
|
বাধা এসেছিল ক্রমাগত, বুঝতে পেরেছিলেন, পরাজয় অনিবার্য, সর্বোপরি মাথার উপরে খড়গের মতো ঝুলে আছে অভিশাপ। তবু, রণভূমি ছাড়েননি। সেই চরিত্র মহাকাব্যে ঠিক উপেক্ষিত নয় যদিও, কিন্তু কবি-কল্পনা তাঁকে জীবনের নাটমঞ্চে বিজয়ী করেনি। যেন, দৈবাহত এই মৃত্যুই তাঁর প্রকৃত গৌরব। যেন, তথাকথিত নিয়তির সঙ্গে এই নাছোড় লড়াইটির মধ্যেই নিহিত তাঁর প্রকৃত মহিমা। যেন, কিছু সাশ্রু দীর্ঘশ্বাস-ই তাঁর প্রাপ্য, তার বেশি কিছু নয়।
এই সব গুলিই স্টিভন পল জোবস-এর ক্ষেত্রে সত্য। কিন্তু, এরাই শেষ সত্য নয়।
ভারতীয় কল্পনা কর্ণকে শেষ পর্যন্ত পরাজয় এবং দীর্ঘশ্বাস উপহার দিলেও মার্কিন স্বপ্ন সেই হতাশ্বাস বেদনাকেই ধ্রুব বলে মানতে নারাজ। সুতরাং, স্টিভ জোবস কায়, মন ও বাক্যে জয় কামনা করলেন। পেলেনও।
বাধা ছিল প্রচুর। যে ‘অ্যাপল’ তাঁর হাতে-গড়া, সেখান থেকেই তাঁকে বেরিয়ে আসতে হল। গৌরব নিয়ে নয়, বরং যথেষ্ট অগৌরব-সহকারে বললেই ঠিক হয়। জীবনের ছক তত দিনে বেশ একটা আকার নিয়েছে, চকিতে তা উল্টে পাল্টে গেল। স্টিভ দমলেন না, বরং উপভোগ করলেন এই বেশ-বদল। জীবনকে এমন করে ঢেলে সাজার সুযোগ তো বড় একটা আসে না। সুতরাং, ফের নতুন করে ঘুঁটি সাজানো শুরু হল। স্বীকৃতি এল, ক্রমে জোয়ারের মতো এল, এবং ঠিক তখনই দেখা দিল আর এক আতঙ্ক। ক্যানসার।
এ বার সরাসরি মৃত্যুর চোখে চোখ রাখলেন স্টিভ। খুব অনায়াসে নয় নিশ্চিত, ভিতরে ভিতরে তাঁকে দুঃসহ একটি যুদ্ধ করতে হল, কিন্তু কালো টি আর নীল জিনস, সঙ্গে আলতো দাড়ির ফাঁকে জেগে ওঠা হাসি ভেদ করে সেই লড়াই লোকচক্ষুর সমক্ষে এল না।
বলা উচিত, আসতে পারল না।
ঠিক যে ভাবে বছরের পর বছর তিনি নিজের ভিতরেই রেখে দিতেন বিভিন্ন পরিকল্পনা, মনের মধ্যে চলত তাদের লালন পালন, ঠিক তেমনই। একটি ছোট্ট দৃষ্টান্ত দেওয়া জরুরি। মাত্র গত বছর নভেম্বরে ‘বিটলস’-এর গান এল ‘আইটিউন’-এ। এই আগমন আসলে স্টিভ জোবস-এর বহু দশকের স্বপ্ন। পূরণ হল জীবনের প্রায় শেষে, কিন্তু তার বহু আগেই স্টিভ শুরু করেছিলেন বিজ্ঞাপনের বিন্যাস, নিজেই গড়তেন নানা লে-আউট, ‘বিটলস’ যখন সত্যিই ‘আইটিউন’-এ আসবে, কী ভাবে সেই বার্তা যাবে দিকে দিগন্তরে...!
এই বিন্যাসের নাম ‘পরিকল্পনা’। এই বিন্যাসের নাম ‘স্বপ্ন’-ও বটে। নিখাদ মার্কিন স্বপ্ন।
সেই স্বপ্ন যা নির্ভুল বুঝে নিতে পারে বাজারের মন।
সেই স্বপ্ন যা সময়ের চেয়ে আগুয়ান।
সেই স্বপ্ন যা আইফোন, আইপড বা আইপ্যাড-এর মতো যন্ত্র দিয়ে প্রকৃতপক্ষে এক-একটি নতুন যুগ এবং যুগান্তর ঘোষণা করতে পারে।
সেই স্বপ্ন যার সারাৎসার লুকিয়ে আছে মার্কিন সমাজের বুনোটে। এক দিকে হার না-মানা, অন্য দিকে জয়লাভের আকুলতায় তীব্র একটি বুনোটে।
পৃথিবীতে মার্কিন সমাজের অতুলনীয় মহিমাটি ঠিক কোথায়, এই মুহূর্তে তার উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত হয়ে রইল একটি জীবন। আসলে, বিপুল একটি জীবন এবং সংক্ষিপ্ত একটি মৃত্যু।
স্টিভন পল জোবস। |
|
|
|
|
|