বাঁকুড়ার বিভিন্ন পারিবারিক দুর্গাপুজোর মধ্যে রাজগ্রামের লক্ষ্মণবাড়ির পুজো অন্যতম। এখানে দেবী দুর্গার সঙ্গে থাকে না লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক ও গণেশ। থাকে না মহিষাসুরও। এখানে দেবী দশভূজা নয়। শুধু মাত্র দেবীর মুণ্ড পুজা হয়। প্রায় ৩৫০ বছরেরও বেশি প্রাচীন এই পুজোকে এখানকার স্থানীয় ভাষায় বলা হয় ‘মুয়া পুজো’।
লক্ষ্মণবাড়ির পরিবার সূত্রে জানা যায়, তাঁদের পূর্বপুরুষেরা পেশায় গুণিন ছিলেন। তাঁদের মধ্যে নৃসিংহ লক্ষ্মণ ছিলেন বড় গুণিন। তিনি এক বার সপরিবারে কামাক্ষ্যায় গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি দেবীর মুখ মণ্ডলের স্বপ্ন দেখেন বলে কথিত রয়েছে। একটি ঝোপের মধ্যে দেবী অত্যন্ত অযত্নের মধ্যে পড়ে রয়েছেন। সেখান থেকে তাঁকে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে যথাযোগ্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করে পুজো করার নির্দেশ দেন দেবী। সেই ঝোপ থেকে দেবীর মুণ্ড খুঁজে পাওয়া যায়। দেবীর মুণ্ড নিয়ে তিনি বাড়ি ফেরেন। প্রায় ৩৫০ বছর আগের ঘটনা। তার পর থেকে প্রতি বছর লক্ষ্মণবাড়িতে দেবী দুর্গার পুজো হয়ে আসছে।
ওই পরিবারের সদস্য দেবাশিস লক্ষ্মণ ও রঞ্জিত লক্ষ্মণ বলেন, “এই পুজোর কয়েকটি নিয়ম রয়েছে, যা আমরা কার্যত অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলি। তার অন্যথা হওয়ার উপায় নেই।” যেমন, পুজো হয়ে গেলে দেবীর মুণ্ড একটি মাটির হাঁড়ির ভিতরে রাখা হয়। পরের বছর সপ্তমীর দিন ফের মুণ্ড বের করে পুজো করা হয়। মন্দিরে মূর্তি স্থাপন করার পরে পুজো শুরু হয়। আমাদের পরিবারের সদস্যেরা ছাড়া আর কেউ দেবীর মূর্তি বের করতে পারেন না। কোনও কারণেই এই নিয়ম ভাঙা যায় না। এমন কি পুরোহিতও মূর্তি ছুঁতে পারেন না। এখানকার মন্দিরে বৈদ্যুতিক আলো জ্বলে না। সে নিয়মও নেই। পুজোর ক’টা দিন সন্ধ্যায় মন্দিরে ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালানো হয়। দেবীর মুণ্ডে রঙ করাও হয় না।
তাঁদের কাছে শোনা গিয়েছে, প্রায় ২০০ বছর আগে দেবীর মুণ্ড রঙ করার জন্য এক স্থানীয় শিল্পীর কাছে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু, পরে দেখা যায়, শিল্পীর কাছে দেবীর মুণ্ড নেই। বাড়ি ফিরে পরিবারের লোকজন দেখেন সেই হাঁড়ির ভিতরে দেবীর মুণ্ড রয়েছে।
লক্ষ্মণবাড়ির বধূ উমা লক্ষ্মণ, ঝর্ণা লক্ষ্মণেরা বলেন, “পূর্বপুরুষদের সমস্ত প্রথা আজও আমরা বজায় রেখেছি। পুজোর দিনগুলি আমরা দেবীর পুজোয় মেতে থাকি। পুজো শেষ হয়ে গেলে তাই মন খারাপ হয়ে যায়।”
লক্ষ্মণবাড়ির পুজো নিছক পারিবারিক পুজো নয়। স্থানীয় বাসিন্দারাও এই পুজোয় মেতে ওঠেন। তাঁদের মধ্যেও এই পুজো নিয়ে যথেষ্ট উৎসাহ দেখা যায়। স্থানীয় বাসিন্দা অজিত দত্ত, কার্তিক দাশ, পরেশ দত্তরা বলেন, “এই পুজোর একটা ঐতিহ্য রয়েছে। দেবীর মাহাত্ম্যও কম নয়। পুজো দেখতে দূর থেকেও অনেকে আসেন। অনেকে দেবীর কাছে তাঁদের বাসনার কথা জানান।” |