বছর ছ’য়েক আগের কথা। ষষ্ঠীর সকাল থেকেই বিভিন্ন নামি দামি পুজো মণ্ডপে কেমন একটা চাপা উত্তেজনা। উৎসব কাপের বিচারকেরা বেরিয়েছেন। মণ্ডপ, পরিবেশ-আবহ আলোকসজ্জার সঙ্গে সঙ্গে মা দুগ্গাও নম্বর পাচ্ছেন। কখনও দশে সাত, কখনও তিন, কখনও পুরো দশ। কিন্তু নম্বর দেনেওলারা কখন কোথায় যাবেন, তা কিন্তু কেউ জানেন না। ফলে সমস্যায় পড়েছেন উদ্যেক্তারা। সোজা হিসেবটা হল, বিচারকেরা এলে এক রকম গান বাজানো হবে, না থাকলে আর এক রকম গান বাজবে। বিচারকেরা থাকলে মৃদু স্বরে রবীন্দ্রসঙ্গীত, নিদেনপক্ষে অতুলপ্রসাদী। না থাকলে সোজাসুজি হিন্দি সিনেমার গান।
ফলে সকাল থেকেই বিচারকদের আসা নিয়ে আশা-আশঙ্কা অনুযায়ী মাইকের আওয়াজ কমছে বা বাড়ছে। পাড়ার মোড়ে দু’টো গাড়ি এক সঙ্গে দেখা গেলেই মাইক মিইয়ে যাচ্ছে। ‘কোই মুঝে জঙ্গলি কহে’ থেকে ‘আপ কি আঁখো মে’, সব বাদ। এমনই এক সময়, হাল ছেড়ে দিলেন পাড়ার ছেলেরা। তাঁরা রেগেমেগে বলিউডেই প্রাণমন নিবেদন করলেন। বিচারকেরা এলে আসবেন, আর সহ্য হয় না। পুজো বছরে একবারই আসে। আমোদে কমতি মানা হবে না। রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্যাসেট ফিরিয়ে দেওয়া হল। এবং সত্যি সত্যি যখন বিচারকেরা রাত ন’টা নাগাদ আচমকা হাজির হলেন, তখন তারস্বরে বাজানো হচ্ছে হিন্দি চলচ্চিত্রগীতি। বিচারকদের ভুরু কুঁচকে উঠতেই পাড়ার এক বাচ্চা মেয়েকে সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে এনে মাইকের সামনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়। সে আধো আধো গলায় গেয়ে ওঠে ‘আজ আমাদের ছুটি রে ভাই আজ আমাদের ছুটি’। এই অভিনবত্বে আপ্লুত বিচারকেরা আবহে দশে আট দিয়ে দিয়েছিলেন, কারণ উদ্যোক্তারা বুঝিয়েছিলেন, তাঁদের সেবারের থিম নাকি, ‘আমাদের পাড়াই আমাদের পরিবার।’
এ বার কিন্তু সত্যি বলতে কি, সেই গুঁতোগুঁতি আর শুনতে হয়নি। এ বারে ফ্যাশন স্টেটমেন্টই হল, নীচু স্বরে বাজানো রবীন্দ্রসঙ্গীত। কি থিমের পুজো, কি সাবেকি পুজো, বিচারকেরা কোথাও কোনও হিন্দি গানের কলি শোনেননি। বাংলা গানই বেজেছে। দেবব্রত বিশ্বাস, ঋতু গুহ থেকে মান্না দে, শ্যামল মিত্র। বাংলা ব্যান্ড, বাউল। কেন এমন হচ্ছে? মাইক ব্যবসায়ী পার্থ বিশ্বাস বলেন, “ছ:টি পুজো কমিটি মাইক ভাড়া নিয়েছে। সকলেই বাংলা গান চেয়েছে। তা-ও বাজাতে হবে শব্দ কম রেখে। আগে লোকে ঢাকের বোলও চাইত। এ বার তা-ও চায়নি। এমনকী মহালয়ার ক্যাসেটের চাহিদাও রবীন্দ্রসঙ্গীতের কাছে হেরে গিয়েছে।”
বেসরকারি চাকুরে অমিতাভ চক্রবর্তী বলেন, “পুজোর সময় পাড়ার ছেলেরা বড্ড জোরে হিন্দি গান চালাত। এ বার কিন্তু সত্যিই অন্যরকম। নিয়ন্ত্রিত স্বরে নির্বাচিত গান বাজছে মণ্ডপে মণ্ডপে।” উদ্যেক্তারা আগে শব্দনিয়ন্ত্রণ বিধির সঙ্গে যে লুকোচুরি খেলতেন, এ বার তা-ও খেলতে হয়নি। তাঁরা নিজেরাই স্বর নামিয়ে রেখেছেন আগাগোড়া। বর্ধমানের স্কুল শিক্ষক অঞ্জন চতুর্বেদী বলেন, “এমনই হচ্ছে যে, মনে হচ্ছে, সব পুজো উদ্যোক্তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, রবীন্দ্রসঙ্গীতই বাজানো হবে।” সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র অংশুমান সেনগুপ্তের বক্তব্য, “কৌলীন্যের প্রতি নজর বাড়ছে। তাই রবীন্দ্রজন্মের সার্ধশতবর্ষের উদ্যাপনের মেজাজটা রয়ে গিয়েছে পুজোতেও।” তিনি বলেন, “কিন্তু আরও একটা কথা হল, এই সময়ের সাধারণ হিন্দি সিনেমার গানও দেখবেন, আগের মতো উচ্চকিত নয়। সব মিলিয়েই সমাজের নজর বদলাচ্ছে।” |