সময়টা যুদ্ধের, সালটা ১৯৭১। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শেষ হওয়ার মুখে। সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর ৮৩ নম্বর ব্যাটালিয়ন একটি পাক সেনা ঘাঁটির দখল নিয়েছে।
ল্যান্স নায়েক শেরবাহাদুর ঠাকুরির হঠাৎ নজর পড়ল সেনা-ঘাঁটির একটি বাড়ির ছাদের দিকে। একটি মেশিনগান ছাদে বসানো রয়েছে। তরতরিয়ে উঠে গেলেন ঠাকুরি। মেশিনগানটি খুলতে যেতেই বিপত্তি। ছিটকে বেরোতে লাগল গুলি। উল্টোদিকের একটি দেওয়াল গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেল। পড়ন্ত সূর্যের আলো পড়েছে দেওয়ালে। ঠাকুরির চোখে যেন ধাঁধা লাগল। দেওয়ালের ভিতরটা যেন সূর্যের আলো পড়ে ঝকঝক করছে। তবে কি পাক-সেনাদের ফেলে যাওয়া গুপ্তধন? দেওয়ালের কাছে যেতেই মিলিয়ে গেল সোনালি ঝলকানি। সারা রাত ঠাকুরির চোখে ঘুম এলো না। ব্যাপারটা কী? পরের দিন সকালে ঠাকুরি আবার এলেন সেই দেওয়ালের কাছে। আস্তে আস্তে দেওয়ালের ইট-পলেস্তারা ছাড়াতেই বেরিয়ে এল ‘গুপ্তধন’, অষ্টধাতুর দশভুজা মূর্তি।
হাজার প্রলোভন, লক্ষ লক্ষ টাকার ‘অফার’, সব উপেক্ষা করে ‘দেবী মা, শেরাওয়ালি’-র ভারি মূর্তিটি নিয়ে ঠাকুরি হাজির হলেন ব্যাটালিয়নের সদর দফতরে। ঠাকুরি ও তাঁর ঠাকুরকে ঘিরে ব্যাটালিয়নের অফিসার থেকে জওয়ান, সক্কলে। কী করা হবে মূর্তিটিকে নিয়ে? জওয়ানরা দাবি তুলল, প্রতিষ্ঠা করতে হবে দেবী মা-র মূর্তিটি। সেই থেকেই ৮৩ নম্বর ব্যাটালিয়নের আরাধ্যা অষ্টধাতুর ওই দুর্গামূর্তি। ৮৩ নম্বর ব্যাটালিয়ন কর্মসূত্রে কোথাও গেলে দেবী মা-ও সঙ্গে যান। তবে যেখানেই থাকুন না কেন, পুজোর সময় ৮৩ ব্যাটালিয়নের দেবী মা, শিলঙের মাওপাতের সদর দফতরে ফিরবেনই। হবে দশভুজার আরাধনা। |
শিলঙের ৮৩ নম্বর ব্যাটেলিয়নের অষ্টধাতুর দুর্গা প্রতিমা। —নিজস্ব চিত্র |
শেরবাহাদুর ঠাকুরি অবসর নিয়েছেন কবেই। কিন্তু তাঁর দেবী-প্রাপ্তির গল্প শিলঙের লোকের মুখে মুখে আজও ফেরে। দুর্গা পুজোর এই মরশুমে শিলঙের অবশ্য দ্রষ্টব্যের তালিকার এক নম্বরে, ষষ্ঠ শতকে তৈরি ৪৫ কিলোগ্রাম ওজনের এই অষ্টধাতুর দশভুজা মূর্তিটি। ৫৬টি বারোয়ারি আর ৯টি বাড়ির পুজো মিলিয়ে শিলং এখন জমজমাট। তবে ‘হল অফ ফেম’ হয়ে যাওয়া বিএসএফ-এর অষ্টধাতুর দুর্গা আর শের বাহাদুর ঠাকুরির দুর্গা উদ্ধারের কাহিনী এখনও রূপকথার গল্পের মতোই মানুষকে বারবার মুগ্ধ
করে। দুর্গা উদ্ধারের আশ্চর্য কাহিনী আর লোভ জয় করা এক জওয়ানের আবেগ, মিলেমিশে এক হয়ে গিয়েছে এই পুজোয়।
শিলং-এ লোক টানা পুজোর কথা বলতে গেলে, প্রথমে জেল রোডের নাম নিতেই হবে। জেল রোডের হিট পুজোয় এবারের থিম কেল্লা। ধুবুরি, বিলাসিপাড়ার শিল্পীদের হাতে গড়া এই কেল্লা রাজকাহিনীকে মনে করাবে। সেই সঙ্গে রয়েছে আলিপুরদুয়ারের শিল্পীদের আলোর খেলা। ভিতরে সাদা প্রতিমার সগর্ব উপস্থিতি। কেল্লার চত্বর পার হয়েও পিছু ছাড়বে না রাজস্থান। লুকিয়ের রোডের শ্রী শ্রী রাজস্থানী দুর্গা পুজা সমিতি পুজোর কদিন টানা রাজস্থানী নাচ-গানের আসর বসাবে মণ্ডপে। তবে উদ্যোক্তা ও থিম রাজস্থানের হলেও, মূর্তির বেলায় কিন্তু আদি-অকৃৃত্রিম কুমারটুলি এবারেও রাজস্থানী দুর্গা পুজার তুরুপের তাস।
জেল রোড সোনার কেল্লা করে বাজার কাঁপালে, রিলবংই বা পিছিয়ে থাকবে কেন? তাঁদের সোনার মন্দির আলো ঝলমল করছে। অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরের আদলে বানানো এই মণ্ডপ কিন্তু বাংলা বা অসমের শিল্পীদের হাতে গড়া নয়। খাসি শিল্পীদের জাদুর ছোঁয়ার পাহাড়ি শহরে প্রাণ পেয়েছে শিখ ধর্মস্থল।
নিউ কলোনি দুর্গা পুজো এবার প্লাটিনাম জুবিলিতে পা দিয়েছে। এবার তাদের থিমে বাংলার গ্রাম।
প্রায় ১২ বছর ধরে, পুজোর দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন প্রমীলা বাহিনী। ঠাকুর গড়েছেন কুমারটুলির অমর পাল। |