শুধু আলো, প্রতিমা আর মণ্ডপ যত প্রাইজ নিয়ে যাবে! এই বিশ্বমানের হাল্কা মুচমুচে রাধাবল্লভী, ঝরঝরে সাত্ত্বিক পোলাও বা স্নিগ্ধ পায়েসের জন্য কোনও পুরস্কার নেই?
অষ্টমী কি নবমীর দুপুরে উত্তর বা দক্ষিণ কলকাতার বারোয়ারির পংক্তিভোজে বসলে এই ঘোর ‘অবিচার’-এর বিরুদ্ধে অবশ্যই প্রতিবাদের ইচ্ছে হবে। বেলুড় মঠের খিচুড়ি-ভোগ তো অপার্থিব, শহরের বড়-মেজ বহু পুজোর ভোগেই ঘোর সংশয়ীও দ্রবীভূত হবেন।
মণ্ডপে গিজগিজে ভিড়ের নেপথ্যে এ যেন এক রাজসূয় যজ্ঞ। আগের দিন সন্ধিপুজোর ঝক্কিতে মাঝরাত গড়িয়ে গেলেও নবমীর সকালে ঠিক সময়ে বাগবাজারের মণ্ডপে হাজির ৭০ ছুঁই ছুঁই ভারতী মুখোপাধ্যায়। একডালিয়ার মণ্ডপের ৭-৮টা বাড়ি পিছনে তপতী বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ির হেঁসেলেও তো গত তিন দিন ভোগ-রান্না চলছে। নবমীর দুপুরে বাগবাজারের মণ্ডপের ঠিক পিছনে গরমে ঘামতে ঘামতে ভারতীদেবীকে মহিষাসুরের খাবারের ভাগ বাড়তে দেখা গেল। না হয় মা দুগ্গা প্রকাণ্ড বর্শার ফলায় তার বুক খুঁচিয়ে একসা করছেন, তা বলে অসুর বেচারা কি উপোস করে থাকবে? দুর্গা, চণ্ডীর আলাদা থালা। অন্য থালায় মায়ের ছেলেমেয়ে, নবপত্রিকা, অসুর, বাহনকুল সবার জন্য যত্ন করে বেড়ে দেওয়া হয়। প্রায় খান পঞ্চাশ মালসাতে মণ্ডপে ভোগ নিবেদন দস্তুর।
বাগবাজারের মণ্ডপে ভোগের নেপথ্যে গত তিন দশক ধরে প্রমীলা-বাহিনীর নেতৃত্বে কালীপ্রসাদ চক্রবর্তী স্ট্রিটের বাসিন্দা, প্রয়াত পুজো-কর্তা মদন মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী ভারতীদেবী। পাড়ার গিন্নিরা স্নান সেরে শুদ্ধ বস্ত্রে দল বেঁধে তাঁর হাতে-হাতে কাজ সারেন। এমনিতে ছেলের কাছে মুম্বইয়ে থাকলেও একডালিয়ার তপতীদেবী পুজোর সময়ে পাড়াছাড়া হবেন না। পুজো-কর্তা সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেন, “আমাদের ভোগের দিনাজপুরের তুলাইপঞ্জি চাল তপতীদেবীই ম্যানেজ করতে পারেন।” দিনভর উপোস থেকে পুরোভাগে তপতীদেবী। মিহি ধবধবে চালটা এক জন কড়ায় ঢালছেন, তো গলে যাওয়ার ভয়ে আর এক জন তা মিনিটে তুলে নিচ্ছেন, এ দৃশ্য দেখার মতো। এই চাল ফুটিয়ে জল ঝরাতে যেন বাচ্চা ছেলেকে চান করানোর মমতা।
কাশী বোস লেনের মণ্ডপের উল্টো ফুটপাথে চোপরাদের বাড়ির ছাদেও তো সেই কবে থেকে কর্মকাণ্ডের শুরু। কেশর রাবড়ি, শিঙাড়া, বরফি, পেঁড়া, মাঠি, ক্ষীরমোহন, সীতাভোগ, ছোলার ডাল, মুগ ডাল, পুরীতে নবমীর ‘ছাপ্পান্ন ভোগ’ রান্না কি চাট্টিখানি কথা! নবমীর বিকেলে ভোগবাহকেরা গঙ্গাস্নান সেরে নতুন কাপড় গায়ে চারতলা থেকে দৈত্যাকার থালা ঘাড়ে নামলেন। বিকেলে থিমের মণ্ডপে কসরত করে ঠাকুরের বেদির নীচে খান ষাটেক থালা সাজানো হল।
ভোগের জন্য কোনও পুরস্কার থাকলে বেশ কয়েকটা পুজোকে ঠেকানো মুশকিল হত। দক্ষিণের ত্রিধারায় পুজোর মধ্যে দু’দিনই মাছ-মাংসযোগে আমিষ-ভোগ। অষ্টমীতে শুধু নিরামিষ। সল্টলেকের এফডি ব্লকে তিন দিনে প্রায় ১০ হাজার লোকে তৃপ্তি করে খাবেন। হিন্দুস্থান পার্ক সর্বজনীন, ম্যাডক্স স্কোয়ার, সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার, সঙ্ঘশ্রী, খিদিরপুর ২৫ পল্লি বা বাদামতলা আষাঢ় সঙ্ঘও ভোগের মানের নিরিখে কলকাতার কুলীন। একডালিয়ার পুজোতেও নবমীতে পাত পেড়ে মাংস-ভাতের ব্যবস্থা।
কাশী বোস লেন অষ্টমীর সন্ধ্যায় জনতাকে উচ্চাঙ্গের মরিচগন্ধী আলুর দম ও রাধাবল্লভী খাইয়েছে। নবমীতে নবরত্ন পোলাও, হালুয়া। সপ্তমীতে দেবীকে নিবেদিত কচুর শাক, অষ্টমীর ঘি-সুরভিত দালিয়ার খিচুড়ি বা পনিরের পায়েসও এক-একটি সমীহযোগ্য আইটেম। ছোট পুজো সন্তোষপুরের শিবতলার মাঠে নবমীতে পাড়ার মেয়েদের আয়োজনে সবাই মিলে ছিমছাম ভোগের আয়োজন।
বরাহনগরের অশোকগড়ে রাজশাহির সাবেক জমিদার-বংশ মজুমদার-বাড়িতেও তিন দিনই কয়েকশো লোক মিলে রুই-ইলিশ-পাবদা-চিংড়ি সাঁটিয়ে ধুন্ধুমার কাণ্ড। রামগড়ে পাবনার সাবেক জমিদার প্রয়াত গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের পরিবারেও নবমীতে পাড়াসুদ্ধ লোককে রুই-ইলিশ খাওয়ানো হল।
দক্ষিণের কোনও বড় পুজোয় আজকাল কুপনে স্পনসরের নামও দেখা যাচ্ছে। তবে বাগবাজারের ধ্রুপদী প্রতিমার পুজোয় ভোগের ‘বাজেট’ নেই। প্রবীণ কর্তা অভয় ভট্টাচার্য বলছিলেন, “কী ভাবে সব ঘটে যায়! হয়তো পোস্তা থেকে হুট করে কয়েক বস্তা মশলা আসবে কিংবা মানসিক করে কেউ অমুক সব্জিটার বন্দোবস্ত করবেন। মায়ের ভোগের ব্যবস্থা মা নিজেই করেন।” |