‘যেটা ছিল না, ছিল না, সেটা না-পাওয়াই থাক
সব পেলে নষ্ট জীবন।’
মহানবমীর বিকেলে দক্ষিণ শহরতলির এক পুজোকর্তার মোবাইলের এই ‘কলার টিউন’ হঠাৎই তাৎপর্যমণ্ডিত হয়ে উঠেছে। গান বেজেই যাচ্ছে। কিন্তু ফোন ধরছেন না তিনি। সপ্তমীর দুপুরে থিম-প্রতিযোগিতার হাওয়া স্পষ্ট হওয়ার পর থেকেই এই অবস্থা। ওই পুজোকর্তা তিন দিন ধরে কার্যত অধরা।
যাদবপুরের বাসিন্দা, এ বারের পুজোর এক সফল থিম-শিল্পীর আবার গত ছ’মাসের টেনশন শেষেও ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও’ বলার জো নেই। সপ্তমীর সকালেই ৮টা বাজার আগে তাঁর বাড়িতে হাজির উত্তরের এক পুজোকর্তা। সনির্বন্ধ অনুরোধ, ‘দয়া করে পরের বার আমাদের উদ্ধার করে দিতেই হবে।’ এ বার যাদের হয়ে কাজ করেছেন, তাদের মধ্যে একটি পুজোর আগামী বছর সুবর্ণ জয়ন্তী। তারাও এ বারের সফল খেলোয়াড়কে আগামী মরসুমে ছাড়তে নারাজ। শিল্পী কাউকেই পাকা কথা দিচ্ছেন না। নিজের দর ধরে রাখতে এখনই চোখ-মুখের আপাত গাম্ভীর্যে টোল পড়তে দিচ্ছেন না।
আজ, বৃহস্পতিবার বিজয়া দশমীর বিকেলে ঠাকুর ভাসান শুরু হওয়ার ঢের আগেই কোনও কোনও পুজোকর্তার কাছে এ বারের পুজো অতীতের তালিকায় ঢুকে পড়েছে। থিম-প্রতিযোগিতায় ব্যর্থতার যন্ত্রণা মিশে বিসর্জনের বিষাদ ঢের আগে থেকেই টের পেতে শুরু করেছেন তাঁরা। সেই সঙ্গে পুজোর পিছনে খরচ করা জীবনের অমূল্য কয়েকটা মাস, দিন বা ঘণ্টার হিসেব, গচ্চা দেওয়া গাঁটের কড়ি, সামগ্রিক ভাবে ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো’র স্মৃতিও তাড়া করছে শহরের কোনও কোনও পুজোর কর্তাকে। নবমীর দুপুরে এক সময়ে হতাশ ভঙ্গিতে চুপি চুপি মণ্ডপ থেকে কেটে বেরিয়ে এসেছিলেন উত্তর শহরতলির এক পুজোকর্তা। স্ত্রীকে ‘আমায় একটু একা থাকতে দাও’ বলে বাড়িতে শুয়ে তিনিও কি ভাবতে পারছেন, পুজোর এই নেশা থেকে মুক্তির কী উপায়?
বুধবার, নবমীর বিকেলে শহরের বেশ কয়েকটি মেজো-সেজো পুজোর কর্তাদের গলাতেই আফসোসের সাতকাহন। হরিদেবপুরের অজেয় সংহতির হিল্লোল বসু বলছেন, “না, আমাদের পুজোর এ বার কোনও মূল্যায়নই হয়নি। দর্শকদের ভালবাসা যথেষ্ট পেয়েছি। কিন্তু কী করলে বড় পুরস্কার পাব, মাথায় ঢুকছে না।” তবু পেশায় ব্যবসায়ী হিল্লোল পুজোর পিছনে তাঁর নিজের লগ্নির হিসেব রাখতে চান না। বরং নবমীর সন্ধেতেও ঘনিষ্ঠ মহলে বলে বেড়াচ্ছেন, “আমার কাজললতার মণ্ডপের শিল্পী বিভাস মুখোপাধ্যায়, সুব্রত মণ্ডলদের তো কোনও দোষ নেই। পরের বারেও ওদের বাদ দেব না।”অমুক প্রতিযোগিতার বিচারকেরা কেন প্রতি বার আমাদের পুজো দেখতে সেই ভরদুপুরে আসেন? সন্ধেয় মণ্ডপের আলোর সাজ কেন এক বারও দেখে যান না?
অভিমান ঘনতর হচ্ছে উল্টোডাঙার যুববৃন্দের নারায়ণ মণ্ডলেরও। ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, “উষ্ণায়নের মতো ‘হট কেক টপিক’ থিম ছিল। গলির মধ্যে গুছিয়ে কাজ করেছি। কেউ সেটা বুঝল না!” তবে এত কষ্টেও পুজোয় নিজের পকেট থেকে ব্যবসার টাকা কতটা দিয়েছেন, বলতে রাজি নন নারায়ণবাবু। কাগজে বেরোলেই বৌ জেনে যাবে যে!
তেলেঙ্গাবাগানের রানা দাস বা কসবার রামলাল বাজারের অনুপম মজুমদারেরাও অনেকটা একই নৌকোর যাত্রী। এই দু’টি পুজোই অবশ্য কিছু কিছু পুরস্কার পেয়েছে। আয়কর বিভাগের কর্মী অনুপমবাবু বললেন, “এ বার একটা সময়ে মনে হচ্ছিল, পুজো বন্ধ করে দিতে হবে। মহালয়ার পরে তখন তেড়ে বৃষ্টি চলছে। ও-দিকে ডেকরেটর বলছে, লেবারের টাকা না-পেলে কাজ করবে না! নানা দিকে নানা চাপ। মনে হচ্ছিল, সব ছেড়েছুড়ে হিমালয়ে গিয়ে বসে থাকি।” তবে সপ্তমী থেকে মণ্ডপে ভিড়ের ঢলে সব চাপ হাল্কা হয়ে গিয়েছে। এ বার কারা যেন এই পুজোকে ‘সেরা আবিষ্কার’-এর শিরোপা দিয়েছে। খুশি হলেও দেড় দশক ধরে কলকাতার পুজোর সঙ্গে যুক্ত এক যুবক ম্লান হাসেন, “ধারাবাহিক ভাবে সাধ্যমতো ভাল কাজ করলেও এখনও আমরা নেহাতই আবিষ্কারের স্তরে থেকে গেলাম!”
নবমীর বিকেলেই টিকে থাকার ফর্মুলা খুঁজছেন তেলেঙ্গাবাগানের রানা দাসও। তাঁর মতে, মাথার উপরে নেতা-মন্ত্রী নেই, পুঁজিও সামান্য। এই অবস্থায় থিমের লড়াইয়ে টিকে থাকাটা ক্রমশ ‘অসম যুদ্ধ’ হয়ে উঠছে।
রানাবাবুর কথায়, “রঙিন বাঁশ নিয়ে আমাদের এ বারের থিমটা সস্তায় পুষ্টিকর বলা যায়। ভাসানের পরের দিনেই ফের মিটিংয়ে বসছি। পরের বারেও এমন একটা কিছুই ভাবতে হবে।”
রানাবাবু বা বেহালার নূতন দলের সন্দীপন বন্দ্যোপাধ্যায়, দু’জনের জীবনেই পুজোর জন্য ‘সঙ্গত’ কারণে স্ত্রীর গঞ্জনা শুনতে হয়েছে যথেষ্ট। গত তিনটে মাস শুধু খেতে বা ঘুমোতে বাড়ি ঢোকা। পুজোর বাজারের দায়িত্বটাও এড়িয়ে যেতে হয়েছে। পেশায় সরকারি কর্মচারী সন্দীপনবাবু অবশ্য এ বার অনেকটাই সান্ত্বনা খুঁজে পেয়েছেন। সেই কলেজে পড়ার সময় থেকে ২৮ বছর ধরে পুজো করছেন তিনি। এ বারেই ভিড়ের বহরে রেকর্ড গড়েছে তাঁদের পুজো। সন্দীপনবাবুর কথায়, “ছ’বছর আগের দিনগুলো মনে পড়ে যাচ্ছে। যখন বিরাট ঠাকুর, চন্দননগরের আলো নিয়েও রাত ১০টার পরে মণ্ডপে স্রেফ মাছি তাড়াতাম।” তবে তাঁরও মনে হয়, আরও বড় কিছু পুরস্কার এ বার প্রাপ্য ছিল।
গলির ভিতরের কোনও ছোট পুজো এর মধ্যেই হেভিওয়েট শিল্পীর সঙ্গে কথা বলে ‘রেট’ শুনে ধাক্কা খেয়েছে। নামী শিল্পীদের দিয়ে কাজ করিয়েও তেমন কিছু না-পেয়েই কয়েকটি পুজো হতাশ। এরা সকলেই ইতিমধ্যে পরের বারের ভাবনা ভাবতে শুরু করে দিয়েছে।
এই ‘হাল ছেড়ো না বন্ধু’ মনোভাবই তো কলকাতার পুজোকে বছর বছর নতুন উত্তরণের পথে এগিয়ে দেয়।
শহরের পুজো-পাগলেরা জানেন। |