কালো হিরের পুজোর দ্যুতি ম্লান।
চোরাই কয়লার কারবারে ইদানীং অনেকটাই আগল পড়েছে। খনি এলাকায় কাঁচা টাকার ওড়াউড়ি কমেছে। সেই সঙ্গে জলসার জমকও।
দুর্গা ও কালীপুজো কাবার করে ফি বছরই নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত বড় বাজেটের জলসা হয় কয়লাঞ্চলে। তার তোড়জোড় শুরু হয়ে যায় পুজোর আগেই। কিন্তু এ বার কোনও সাড়াশব্দ নেই। অন্য বারের মতো শানু, জিৎ-শ্রাবন্তী, রাহুল-প্রিয়ঙ্কা, জলি মুখোপাধ্যায়, মিতা চট্টোপাধ্যায় বা বিনোদ রাঠোরের জলসার পোস্টারও পড়ছে না।
খনি অঞ্চলে যাত্রা ও জলসার অন্যতম এজেন্ট ‘যাত্রা মন্দির’। রানিগঞ্জের রানিসায়র মোড়ে তাদের অফিসে গিয়ে দেখা মেলে কর্ণধার ভক্তি মাহাতোর। হতাশ গলায় তিনি বলেন, “বারাবনিতে চারটে, জামুড়িয়ায় একটা, রানিগঞ্জে দু’টো আর অন্ডালে একটা বড় বাজেটের অনুষ্ঠান হচ্ছে না। এখনও বুকিং হয়নি। এ বার যে কী হবে, কে জানে!’’ কারণ? “উদ্যোক্তাদের কাছেই জেনে নিন।”
আগে বারাবনির ৫২ বছরের পানুড়িয়া গ্রাম যাত্রা কমিটির উদ্যোগে প্রতি বছর যাত্রা হত। বীণা দাশগুপ্ত, অরুণ দাশগুপ্ত, শেখর গঙ্গোপাধ্যায় থেকে শান্তিগোপাল বন্দ্যোপাধ্যায়, কে যাত্রা করে যাননি সেখানে! যাত্রার বাজার পড়তে শুরু করলে ১৯৮৭ সালে রবি ঘোষকে এনে অনুষ্ঠান করানো শুরু হয়েছিল। এর পরে বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়, সুখেন দাস, শতাব্দী রায়, প্রসেনজিতের মতো অনেক তারকাই ঘুরে গিয়েছেন। গত বার এসেছিলেন জিৎ-শ্রাবন্তী। এ বার আর কেউ আসছেন না।
পানুড়িয়ার আয়োজক সংস্থার কর্ণধার মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “প্রথম দিন যাত্রাটা হবে। কিন্তু দ্বিতীয় দিন আর অনুষ্ঠান হবে না।” কেন? তাঁর ব্যাখ্যা, “দিঘলপাহাড়ি কোলিয়ারি বন্ধ, গৌরান্ডি কোলিয়ারি বন্ধের মুখে। বাজার খারাপ।” কিন্তু কোলিয়ারি বন্ধ হলেও কর্মীরা তো চাকরি হারাননি? সংলগ্ন খনিতে বদলি হয়েছেন। তাতে তো এলাকার অর্থনীতি বিশেষ ধাক্কা খাওয়ার কথা নয়! তা হলে? মোহিতবাবু নিরুত্তর।
১৯৭৩ সালে গৌরান্ডিতে তৈরি হয়েছিল জয়শঙ্কর ক্লাব। প্রথম বছর থেকেই বড় বাজেটের যাত্রার আসর বসত। শেষ সাত বছর বসছিল জলসা। ২০০৮ সালে এসেছিলেন রবিনা ট্যন্ডন, ২০০৯-এ কোয়েল মল্লিক, গত বার রাহুল-প্রিয়ঙ্কা। আর এ বার? ক্লাবের দিলীপ রুইদাস বলেন, “খয়রাবাঁধ ওসিপি বন্ধ, গৌরান্ডিও বন্ধের মুখে। বাজার মিলবে না।” অবৈধ কয়লার কারবার ফের পুরোদমে চালু হলেও কি এই কথা বলবেন? জবাবে মিলল নিঃশব্দ হাসি।
গৌরান্ডির ‘ছন্নছাড়া’ তৈরি হয়েছিল ১৯৮৫-তে। প্রথমে যাত্রা, পরে জলসা। গত বছর এসেছিলেন কুমার শানু। আয়োজকদের তরফে রামেন্দু দাস পরিষ্কার বলেন, “অবৈধ কয়লার কারবার প্রায় বন্ধ। ছোট কারখানাগুলো ওই কয়লাতেই চলে। সেগুলি হয় বেহাল বা প্রায় বন্ধ। জলসায় বাজার মিলবে না।” ১৬ বছর ধরে অপেশাদার যাত্রা প্রতিযোগিতার আয়োজন করে আসছে বারাবনির জামগ্রাম আঞ্চলিক জনসাংস্কৃতিক মঞ্চ। তবে গত আট বছর ধরে যা হয়ে এসেছে, সেই পুরস্কার বিতরণের দিন কলকাতার যাত্রার দল আনার কথা তাঁরা ভাবছেন না।
আগে হত চার দিনের যাত্রা। ২০০১ সালে দেবশ্রী রায়ের অনুষ্ঠান দিয়ে শুরু করেছিল রানিগঞ্জের সিহারশোল স্পোর্টস অ্যান্ড কালচারাল অ্যাসোসিয়েশন। শেষ বার আসেন জিৎ-শ্রাবন্তী। সংগঠনের তরফে আদিত্য মুখোপাধ্যায় অবশ্য বলেন, “বাজার খারাপ। তবে আমরা কিছু না কিছু করবই।” জামুড়িয়ার বীজপুরে, অন্ডালের বহুলাতেও এ বার আর কোয়েল মল্লিক বা মৌরি-সঞ্চিতাদের দেখা যাবে না। নিমচা বা বল্লভপুরেও না।
সব মিলিয়ে কিছুটা মনখারাপ কয়লা অঞ্চলের। তবে তার জন্য মাফিয়ারাজ পুরোদমে ফিরে আসুক, এমন কথা অবশ্য কেউই বলছেন না। অন্তত প্রকাশ্যে। আবার চোরা কারবার বন্ধ হয়েছে, এমন কথাই মানতে রাজি নন অনেকে। সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য গৌরাঙ্গ চট্টোপাধ্যায় যেমন বলেন, “কাকভোরে ঠেসা-সাইকেল-লরিতে কী পাচার হচ্ছে, সকলেই দেখতে পাচ্ছে। আমাদের কিছু বলার নেই।” তৃণমূলের রানিগঞ্জ ব্লক কার্যকরী সভাপতি বাবু রায়ের বক্তব্য, “কুমারডি, রতিবাটি, শ্রীপুরের মতো কোথায় কোথায় চোরাই কয়লার কারবার চলছে, ও সব এলাকায় গেলেই বোঝা যাবে।”
আসানসোলের মেয়র তথা স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক তাপস বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “রাজ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার আসার পরে কয়লার চোরাকারবার বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তাতে কিছু পুজোর খরচের কাটছাঁট হয়েছে, জলসা হয়তো বন্ধ হচ্ছে। অনেকের মনখারাপ হচ্ছে। কিন্তু সরকারি প্রকল্পেই কাজ মিলবে। চোরাকারবারের দরকার নেই। সুখের চেয়ে স্বস্তি ভাল, এই কথাটা সকলেরই মনে রাখা উচিত।” |