• বিদ্যুৎই পৌঁছয়নি। অথচ গাববেড়িয়া হাসপাতালে পাঠানো হল বিদ্যুৎচালিত একগাদা যন্ত্রপাতি!
• আইসিইউ বলে কিছু না-থাকা সত্ত্বেও সিউড়ি হাসপাতালে দিব্যি পৌঁছে গেল ভেন্টিলেটর মেশিন!
• কাটোয়া হাসপাতালে রেডিওলজিস্ট নেই। তবু তড়িঘড়ি পাঠানো হল আল্ট্রাসোনোগ্রাফি মেশিন!
• অস্ত্রোপচারের পাটই নেই বেলডাঙা হাসপাতালে। কিন্তু অজ্ঞান করার যন্ত্র ‘বয়েলস অপারেটর’ এসে হাজির!
এমন ভুরি ভুরি ঘটনা দেখে-শুনে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের চোখ এখন কপালে। অভিযোগ: ১৯৯৪-এ পাওয়া বিশ্বব্যাঙ্ক-ঋণের প্রায় ৭৫০ কোটি টাকা কার্যত খোলামকুচির মতো উড়িয়ে দিয়েছেন স্বাস্থ্য-কর্তাদের একাংশ। মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ বার এ নিয়ে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। তদন্ত করবে স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের এক কমিটি।
সেই কমিটির তরফেই জানানো হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে স্বাস্থ্য-পরিকাঠামোর উন্নয়নে নামমাত্র সুদে ৭৫০ কোটির ঋণ (সফ্ট লোন) মঞ্জুর করেছিল বিশ্বব্যাঙ্ক, ১৯৯৪-এ। প্রাপ্ত অর্থে রাজ্যের ১৫টি জেলা হাসপাতাল, ৭টি মহকুমা ও স্টেট জেনারেল হাসপাতাল ও ৯৫টি গ্রামীণ হাসপাতালে দামি-দামি যন্ত্রপাতি, ফ্যাক্স মেশিন, কম্পিউটার, শয্যা ইত্যাদি কিনে পাঠানো হয়। সেটা ১৯৯৬-৯৭ সাল। স্বাস্থ্যকর্তারা তখন দাবি করেছিলেন, এতে জেলা ও গ্রামের হাসপাতালে পরিষেবার উন্নতি হবে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে অধিকাংশ যন্ত্রই অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থেকে নষ্ট হয়েছে বলে অভিযোগ।
কেন ব্যবহার করা গেল না যন্ত্রগুলো?
স্বাস্থ্য সূত্রের বক্তব্য: ব্যাপারটার মধ্যে কোনও পরিকল্পনা ছিল না। তাই বিদ্যুৎবিহীন হাসপাতালে জেনারেটর না-বসিয়েই বিদ্যুৎচালিত যন্ত্র পাঠানো হয়েছে। টেকনিসিয়ান নিয়োগ না-করেই দেওয়া হয়েছে আধুনিক যন্ত্রপাতি। ফলে ভেন্টিলেটর, আল্ট্রাসোনোগ্রাফি ও এক্স-রে মেশিন, হাড়ের আঘাত-অস্থিসন্ধির আঘাত-মূত্রনালির সংক্রমণ বা যকৃতের রোগের চিকিৎসার যন্ত্র, মাইক্রোস্কোপ বিভিন্ন হাসপাতালে ডাঁই হয়ে পড়ে থেকেছে, মোড়কও খোলা হয়নি। উপরন্তু বহু যন্ত্র অত্যন্ত নিম্ন মানের হওয়ায় কাজে লাগানো যায়নি।
বিশ্বব্যাঙ্কের ঋণ অন্য ভাবেও জলে গিয়েছে। ওই টাকায় কিছু চিকিৎসককে আমেরিকা-ব্রিটেন-তাইল্যান্ডে পাঠানো হয়েছিল যন্ত্রচালনার প্রশিক্ষণ নিতে। কিন্তু প্রশিক্ষিত চিকিৎসকদের কাজেই লাগানো যায়নি। অভিযোগ, অনেকে দেশে ফিরে প্রশিক্ষণ দিতে রাজি হননি। অনেকে আবার ওঁদের থেকে তালিম নিতে চাননি।
সেই সময়ের স্বাস্থ্য অধিকর্তা প্রভাকর চট্টোপাধ্যায় রয়েছেন অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে। তিনি কী বলেন?
প্রভাকরবাবুর ব্যাখ্যা, “সর্ষের মধ্যেই ভূত ছিল। যে সব স্বাস্থ্যকর্তা যন্ত্র খরিদের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন, নির্মাতা সংস্থাগুলো তাঁদের অনেককে কিনে নিয়েছিল।” তিনি তখন কী করছিলেন, তার জবাব প্রভাকরবাবুর কাছে মেলেনি।
১৯৯৬-৯৭ সালে সংশ্লিষ্ট যন্ত্র কেনার প্রক্রিয়ায় জড়িতদের অন্যতম ছিলেন তদানীন্তন অতিরিক্ত স্বাস্থ্য-অধিকর্তা রানা সিংহ। রানাবাবু অবশ্য কোনও দুর্নীতির কথা মানতে নারাজ। তাঁর কথায়, “টেন্ডারের শর্ত ইত্যাদি (বিড ডকুমেন্টস) তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল এক বেসরকারি সংস্থাকে। তারাই বিশ্বব্যাঙ্ককে সব তথ্য পাঠাত। বিশ্বব্যাঙ্ক অনুমোদন করলে দরপত্রের ছাড়পত্র মিলত। সুতরাং এর মধ্যে স্বাস্থ্যকর্তাদের দুর্নীতির প্রশ্নই ওঠে না।” ‘দুর্নীতি’ হয়েছে কি না, সেটা তদন্তসাপেক্ষ। কিন্তু বিশ্বব্যাঙ্কের টাকা কতটা কাজে লাগল, তা তো এমনিতেই বোঝা যায়! বস্তুত বিভিন্ন হাসপাতালে পনেরো বছর আগে কেনা যন্ত্রগুলোর হাল সম্পর্কে খোঁজ নিতে গিয়ে যে ছবিটা পাওয়া যাচ্ছে, তা মোটেই উজ্জ্বল নয়। যেমন?
যেমন সিউড়ি সদর হাসপাতালের সুপার মানবেন্দ্র ঘোষ জানান, ওই সময়ে পাঠানো তিনটে ভেন্টিলেটর মেশিন এখনও পড়ে আছে। সিস্টোস্কোপ, গ্যাস্ট্রোস্কোপ-সহ বেশ কিছু মূল্যবান যন্ত্রের ‘সিল’ই খোলা হয়নি! হাওড়ার মুখ্য স্বাস্থ্য-আধিকারিক স্বাতী দত্ত বলেন, “তখন আমি হাওড়া দক্ষিণ গ্রামীণ হাসপাতালের সুপার। এখনও বহু মেশিন হাওড়ার নানা হাসপাতালে বাক্সবন্দি।” মুর্শিদাবাদের ইসলামপুর, বেলডাঙা বা কৃষ্ণপুর গ্রামীণ হাসপাতালে রেডিয়্যান্ট ওয়ার্মার, ভেন্টিলেটর, বয়েলস অপারেটর ইত্যাদি পড়ে রয়েছে বলে জানা ন জেলা স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তা।
রাজ্যের প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী সূর্যকান্ত মিশ্র কী বলছেন?
অধুনা বিরোধী দলনেতা সূর্যবাবুর মন্তব্য, “কেউ যদি তদন্ত শুরু করেন, তা হলে বলার কী আছে? তবে আমরাও তদন্ত করেছিলাম। খুব বেশি কিছু পাওয়া যায়নি। বেশির ভাগ যন্ত্র ঠিকঠাক ব্যবহার করা হয়েছে।” |