পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়ন করতে গিয়ে ‘ভুল পথে’ চালিত হয়েছিল দল তথা বামফ্রন্ট সরকার, আর তার রাজনৈতিক খেসারত এখনও দিতে হচ্ছে বলে মনে করছে সিপিএমের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব।
আজ থেকে দিল্লিতে সিপিএমের পলিটব্যুরো বৈঠক শুরু হয়েছে। সেখানে উপনির্বাচনের ফলাফল নিয়ে রিপোর্ট দিয়েছেন বিমান বসু। প্রকাশ কারাট-সহ পলিটব্যুরোর সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের মত হল, পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম তার আদর্শগত অবস্থান থেকে সরে গিয়েছিল। তার ফলেই তিন দশকের অটুট ভোটব্যাঙ্কে ধস নেমেছে। যাঁর নেতৃত্বের দিকে পরোক্ষে এই অভিযোগের আঙুল, ক্ষমতাচ্যুত মুখ্যমন্ত্রী সেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এ বারও পলিটব্যুরোর বৈঠকে আসেননি। পলিটব্যুরো নেতারা মনে করছেন, অনুপস্থিত থেকে বুদ্ধদেব বার্তা দিতে চাইছেন, পলিটব্যুরো যা-ই বলুক, তিনি নিজের ভুল মানতে রাজি নন। তাই অনুপস্থিত থাকলেও তাঁর ঘনিষ্ঠ এক পলিটব্যুরো সদস্যের কাছে মতাদর্শগত নথি সম্পর্কে নিজের মতামত জানিয়েছেন বুদ্ধদেব। পলিটব্যুরোর ওই নেতা তাঁকে লিখিত ভাবে মতামত জানানোর অনুরোধ করলে, বুদ্ধদেব একটি নোটও তৈরি করে দিয়েছেন। সেই নোটে তাঁর নিজস্ব মতামত স্পষ্ট ভাবেই জানানো আছে বলে পলিটব্যুরো সূত্রের খবর।
এখনও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের হাত ধরেই পশ্চিমবঙ্গে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে রাজ্য নেতৃত্ব। কিন্তু পলিটব্যুরোর নেতারা মনে করছেন, বুদ্ধদেবের অবস্থান নিয়ে দলের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যেই বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। বুদ্ধদেব তাঁর অনুপস্থিতির জন্য অসুস্থতার কারণ দেখালেও আজ বিমান বসু বা সীতারাম ইয়েচুরিও এর দায় নিতে চাননি। বিমানবাবু বলেছেন, বুদ্ধদেব কেন আসেননি, পলিটব্যুরোর মুখপাত্র তার জবাব দেবেন। আর ইয়েচুরির উত্তর, “আসেননি কেন, কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যই তা বলতে পারবেন।”
ফলাফলের পর্যালোচনা করতে বসে সিপিএমের পলিটব্যুরো মনে করছে, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের ভুল থেকে এখনও শিক্ষা নেননি রাজ্যের নেতারা। কারণ যে কৃষক-শ্রমিক-খেতমজুরদের সমর্থনে ভর করে কমিউনিস্ট পার্টি পশ্চিমবঙ্গে তিন দশক ধরে ক্ষমতায় ছিল, তারাই শিল্পপতিদের পক্ষে দাঁড়িয়ে কৃষকদের জমি কেড়ে নিচ্ছে, মানুষের কাছে এমন বার্তা গিয়েছে। সমর্থনের মূল ভিত্তি সরে যাওয়ার ফলেই পঞ্চায়েত, লোকসভা ও তার পরে বিধানসভা নির্বাচনে ধারাবাহিক ভাবে ভোট কমেছে বামেদের। গত কালের উপনির্বাচনের ফলও তার প্রমাণ। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আসন ভবানীপুরের কথা ছেড়ে দিলেও, বসিরহাট উত্তরের মতো চার মাস আগে জেতা আসনে হেরে যাওয়া সেই জনভিত্তি সরে যাওয়ারই প্রমাণ বলে মনে করছেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। হারানো জনসমর্থন ফিরিয়ে আনতে দল আগামী দিনে কোন পথে হাঁটবে, সিপিএম নেতৃত্বের সামনে সেই প্রশ্নই এখন বড় হয়ে উঠেছে। চলতি পলিটব্যুরো বৈঠকে ‘মতাদর্শগত নথি’ তৈরির কাজ শুরু হয়েছে।
কারাট-শিবির মনে করছে, লোকসভা ভোটে না হারা পর্যন্ত সংখ্যালঘু অনগ্রসর শ্রেণির স্বার্থরক্ষা বা তাদের জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থার কথাও ভুলে থেকেছে বাম-সরকার। আদিবাসীদের অনুন্নয়নের ফলেই মাওবাদীরা জঙ্গলমহলে জাঁকিয়ে বসেছে। কিন্তু বামফ্রন্ট সরকার বরাবর অনুন্নয়নের বিষয়টি ধামাচাপা দিয়ে রাখতে চেয়েছে। সংবাদমাধ্যমে এই সংক্রান্ত খবরকে ‘চক্রান্ত’ বলে উড়িয়ে দিয়ে এসেছে সিপিএমের রাজ্য নেতৃত্ব। অথচ আদর্শগত ভাবে এই পিছিয়ে পড়া মানুষদের পাশেই দাঁড়ানোর কথা ছিল সিপিএমের। ভোটের ফলে তার প্রতিফলন ঘটেছে। উল্টো দিকে কেরলে জনদরদী নীতির সুফল কুড়িয়েই বিধানসভা নির্বাচনে হার সত্ত্বেও ভাল ফল করেছে পার্টি। অতীতে ত্রিপুরাতেও উন্নয়নের মাধ্যমে আদিবাসীদের মূল স্রোতে নিয়ে এসে জঙ্গি আন্দোলনকে প্রতিহত করা গিয়েছে। ধারাবাহিক হারের চক্র ভেঙে বেরোতে তাই মূল মতাদর্শই আঁকড়ে থাকার কথা বলছেন কারাটরা।
গত কালই সিঙ্গুর জমি মামলার রায় বেরিয়েছে। ‘সিঙ্গুর পুনর্বাসন ও উন্নয়ন আইন’-কে সাংবিধানিক বলে রায় দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট। স্বাভাবিক ভাবেই সিপিএম নেতৃত্ব এই রায়ে হতাশ। রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু মুখে বলছেন, রায় নিয়ে চূড়ান্ত কোনও মন্তব্য করার সময় আসেনি। আর রাজ্যের প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেনের প্রতিক্রিয়া, “আমি কী বলব? আমি কি আইনজ্ঞ?” এই আইনকেই ‘অসাংবিধানিক’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন রাজ্যের নেতারা। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র কালও সেই একই কথা বলেছেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব মনে করছেন, হাইকোর্টের এই রায়েরও রাজনৈতিক প্রভাব পড়বে। তাতে লোকসানই হবে দলের। কারণ বামফ্রন্টের নেতারা এর আগে বরাবর বলে এসেছেন, এক বার অধিগ্রহণ করা জমি কিছুতেই চাষিদের কাছে ফেরানো যায় না। এই যুক্তির অসারতাই প্রমাণ হয়েছে হাইকোর্টের রায়ে। |