জঙ্গলমহলে এ বার রাজ্য সরকারের সঙ্গে মাওবাদীদের সম্মুখ সমরের ইঙ্গিত ক্রমেই প্রকট হচ্ছে।
মাওবাদীরা খুন-সন্ত্রাস বন্ধ না-করলে ‘কড়া হাতে’ই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে চাইছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আবার মাওবাদীরাও মুখ্যমন্ত্রীকে খোলা চিঠি পাঠিয়ে শর্ত দিয়েছে, যৌথ অভিযান, ‘জনজাগরণ মঞ্চ’ বা ‘ভৈরব বাহিনী’র মতো সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলির কার্যকলাপ বন্ধ হলে তবেই আলোচনার বাতাবরণ তৈরি হতে পারে। মমতা ক্ষমতায় আসার পরে মাওবাদীদের তরফে এ যাবৎ এটিই সব চেয়ে ‘কড়া’ চিঠি। সিপিআই (মাওবাদী) নেতা আকাশের নামে পাঠানো যে চিঠিতে মুখ্যমন্ত্রীকে এমন হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়েছে, ‘আপনার ভাষা সংযত হওয়া দরকার। আপনার গলায় তো আজ বুদ্ধবাবুর (প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য) কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছি!’
মুখ্যমন্ত্রী যেমন এক দিকে মধ্যস্থতাকারীদের মারফত মাওবাদীদের স্পষ্ট বার্তা পাঠিয়েছেন তাদের খুন-খারাবি বন্ধ রাখার জন্য, তেমনই জঙ্গলমহল থেকে এক ব্যাটেলিয়ন কেন্দ্রীয় বাহিনী প্রত্যাহারেও তিনি রাজি নন। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিবকে চিঠি লিখে রাজ্য প্রশাসনের তরফে জানানো হয়েছে, ৬ অক্টোবরের মধ্যে জঙ্গলমহল থেকে এক ব্যাটেলিয়ন সিআরপি তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত তাঁরা যেন না-নেন। কেন্দ্রের চিঠি বুধবার মহাকরণে পৌঁছনোর পরে সে দিন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরমের সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলেন বলে প্রশাসনিক সূত্রের খবর।
এর পরে বৃহস্পতিবার মহাকরণে মাওবাদীদের সঙ্গে আলোচনার মধ্যস্থতাকারীদের সঙ্গে বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী স্পষ্টই বলেন, শান্তি আলোচনায় সমস্যা মেটাতেই তিনি উৎসাহী ছিলেন। কিন্তু মাওবাদীরা খুন-সন্ত্রাস চালিয়ে গেলে রাজ্য সরকার চুপ করে বসে থাকতে পারে না। শান্তির লক্ষ্যেই মুখ্যমন্ত্রী মাওবাদীদের অস্ত্র সমর্পণের প্যাকেজ ঘোষণা করেছিলেন। জঙ্গলমহলের বাসিন্দাদের জন্য চাকরির প্রকল্প ঘোষণা করেছেন। কিন্তু মাওবাদীরা সরকারের সেই ‘সদিচ্ছা’য় সাড়া না-দিয়ে খুনের রাজনীতি চালিয়ে যাচ্ছে। প্রশাসনিক সূত্রের খবর, মুখ্যমন্ত্রী এ দিন মধ্যস্থতাকারীদের সাফ বলেছেন, তাঁরা যেন মাওবাদীদের খুনের পথ থেকে অবিলম্বে সরে আসতে বলেন। আলোচনার জন্য তাঁরা সময় নিতেই পারেন। কিন্তু হিংসাত্মক কার্যকলাপ চললে রাজ্যের স্বার্থেই সরকারের পক্ষে অনির্দিষ্ট কাল অপেক্ষা করা সম্ভব নয়। এরই পাশাপাশি, মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, অক্টোবরের মাঝামাঝি জঙ্গলমহলে গিয়ে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে পরিস্থিতি নিয়ে তিনি বৈঠক করবেন। মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসার পরে সেটি হবে জঙ্গলমহলে মমতার দ্বিতীয় সফর।
মহাকরণে এ দিন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পরে অন্যতম মধ্যস্থতাকারী সুজাত ভদ্র বলেন, “সরকার এখনও শান্তি প্রক্রিয়া চাইছে। আমাদের সেই প্রক্রিয়া চালিয়ে যেতে বলা হয়েছে। এ দিনের বৈঠক থেকে সাম্প্রতিক অতীতের কিছু ঘটনা ও গুরুত্বর্পূণ বিষয় জঙ্গলমহলের মেন স্টেক হোল্ডার-দের (মাওবাদী) গোচরে আনতে হবে।” যে কথা মাওবাদীদের ‘গোচরে’ আনার ব্যাপারে সুজাতবাবু ইঙ্গিত দিয়েছেন, প্রশাসনিক সূত্রের খবর, তা আসলে মুখ্যমন্ত্রীর ‘স্পষ্ট ও কড়া বার্তা’। প্রসঙ্গত, এর আগে সুজাতবাবুরা দু’বার বৈঠক করেছেন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে। আগের বার সুজাতবাবু বলেছিলেন, শান্তি প্রক্রিয়া এগোচ্ছে। কিন্তু প্রকাশ্যে তার কোনও প্রতিফলন দেখা যায়নি। তার মধ্যেই জঙ্গলমহলে ‘সক্রিয়তা’ বাড়িয়েছে মাওবাদীরা।
রাজ্য প্রশাসন যখন মাওবাদী মোকাবিলায় ‘কঠোর’ হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন মাওবাদীদের পাল্টা চিঠি জঙ্গলমহলের পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠারই ইঙ্গিত দিচ্ছে। তবে ২৭ তারিখে লেখা ওই চিঠি সংবাদমাধ্যমের একাংশের হাতে এলেও মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয় সূত্রে বলা হচ্ছে তাদের কাছে বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত তা পৌঁছয়নি। চিঠিতে মাওবাদী নেতা আকাশ লিখেছেন, ‘আক্রমণ আর শান্তি আলোচনা একসঙ্গে চলতে পারে না।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, আলোচনার মধ্যস্থতাকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে গিয়েই আমরা কমরেড আজাদের মতো মূল্যবান কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে চিরতরে হারিয়েছি। মধ্যস্থতাকারীদের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করতে গিয়েই আমাদের আরও কিছু কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে গ্রেফতার হতে হয়েছে। যখন আমরা আপনার সরকারের ঘোষিত মধ্যস্থতাকারীদের সঙ্গে আলোচনায় যাচ্ছি, তখনও একই ভাবে আমাদের খতম করতে যৌথ বাহিনী চার দিক থেকে ঘিরছে।’ প্রসঙ্গত, রেলমন্ত্রী হিসেবে জঙ্গলমহলে গিয়ে মাওবাদী নেতা আজাদের মৃত্যু নিয়ে বিচারবিভাগীয় তদন্ত দাবি করেছিলেন মমতা। মাওবাদীরা এখন অভিযোগ করেছে, মমতার সরকারের আমলেই জঙ্গলমহলে এমন পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে, যা আলোচনার পক্ষে সহায়ক নয়।
সরকারের বক্তব্য, মাওবাদীরা জঙ্গলমহলে খুন করতে থাকলে শান্তি আলোচনা সম্ভব নয়। মাওবাদীদের পাল্টা অভিযোগ, শাসক দল তৃণমূলই রাজ্যে সর্বত্র ‘সন্ত্রাস’ চালাচ্ছে। বিরোধী মতাবলম্বীদের খুন করা হচ্ছে, ঘর-বাড়ি ভাঙা হচ্ছে, দলীয় কার্যালয় দখল করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক কালে জঙ্গলমহলে যে দু’জনের খুনের জেরে পরিস্থিতি ঘোরালো হয়েছে, সেই দু’টি হত্যার ব্যাপারেও ‘সাফাই’ দিয়েছে মাওবাদীরা। তাদের আরও অভিযোগ, সংবাদমাধ্যমে যেমনই খবর বেরোক, প্রকৃতপক্ষে অগস্ট থেকেই জঙ্গলমহলে যৌথ অভিযান তীব্র হয়েছে।
এই পরিস্থিতির মধ্যে জঙ্গলমহল থেকে এক ব্যাটেলিয়ন সিআরপি ফেরত দিতে রাজ্য সরকার নারাজ। মহাকরণে এ দিন মুখ্যসচিব সমর ঘোষ প্রশ্নের জবাবে বলেন, “কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক ৬ অক্টোবরের মধ্যে এক ব্যাটেলিয়ান সিআরপি প্রত্যাহার করে নেওয়ার কথা বলেছে। প্রত্যুত্তরে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিবকে চিঠি দিয়ে আমরা বলেছি, এটা করবেন না।” জঙ্গলমহলে এখন ৪১ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী রয়েছে। এর মধ্যে এক ব্যাটেলিয়ন ফেরত দেওয়ার অর্থ, ১০ কোম্পানি নিরাপত্তা বাহিনীকে ছেড়ে দেওয়া। সাম্প্রতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্য স্বাভাবিক কারণেই যা মেনে নিতে রাজি নয়। উল্টে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে যে আরও কেন্দ্রীয় বাহিনী চাওয়া হবে, সেই ইঙ্গিত দিয়েছে মহাকরণ।
মেদিনীপুরে গত মঙ্গলবার রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব এবং ডিজি-র সঙ্গে বৈঠকে জঙ্গলমহলের অধীন চার জেলার এসপি-রা আরও ৩ ব্যাটেলিয়ন কেন্দ্রীয় বাহিনীর দাবি জানান। সাম্প্রতিক অশান্তির পরিপ্রেক্ষিতে জঙ্গলমহলের বিভিন্ন এলাকা থেকে সাধারণ মানুষ সিআরপি-র শিবির করার দাবি জানিয়েছেন। সেই কারণেই এসপি-রা অতিরিক্ত কেন্দ্রীয় বাহিনীর দাবি জানিয়েছেন। স্বরাষ্ট্রসচিব বলেছেন, “আরও কেন্দ্রীয় বাহিনী চেয়ে আমরা কেন্দ্রকে চিঠি লিখব।” কিন্তু সেই চিঠি লেখার আগেই কেন্দ্র এক কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী ফেরত চেয়েছে। মুখ্যসচিবকে এই নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “আগে ফেরত না-পাঠানোর আর্জি মেনে নিক কেন্দ্র। তার পরে নতুন করে বাহিনী চাওয়ার কথা ভাবা হবে।” কিন্তু কেন বাহিনীর একাংশ ফেরত চাইছে কেন্দ্র? জবাবে সমরবাবু বলেন, “প্রয়োজন আছে নিশ্চয়ই। তাই তুলতে চাইছে।” মাওবাদীদের বিরুদ্ধে কি যৌথ বাহিনীর অভিযান ফের শুরু হবে? সরাসরি উত্তর এড়িয়ে মুখ্যসচিব বলেন, “অভিযান শুরু হলে জানিয়ে দেব।” তাঁর কথায়, “অপরাধ হলে (খুনের ঘটনায়) যে রকম পদক্ষেপ করা হয়, তা হচ্ছে।” মহাকরণের খবর, আইজি (পশ্চিমাঞ্চল) জুলফিকার হাসানকে এ দিন বদলি করা হয়। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন মৃত্যুঞ্জয় সিংহ।
মধ্যস্থতাকারীদের সঙ্গে বৈঠকে মমতা এ দিন বলেছেন, তাঁকে এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুকুল রায়, রাজ্যের মন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসুকে খুনের হুমকি দিয়েছে মাওবাদীরা। এই জিনিস কী ভাবে মেনে নেওয়া যেতে পারে? মুকুলবাবু এ দিনই ফের জঙ্গলমহলে গিয়েছিলেন। সেখানে এ বারও সরাসরি মাওবাদীদের নামোল্লেখ করেননি তিনি। তবে ‘যারা মানুষ খুন করছে’, খুনখারাবি বন্ধ করে তাদের ‘শান্তি’ ও ‘উন্নয়নে’র কাজে সামিল হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। কেন তৃণমূলের মিটিং-মিছিলে লোকজনকে আসতে দেওয়া হচ্ছে না, সে প্রশ্নও তুলেছেন।
গত শনিবার পুকুরিয়া থেকে ঝাড়গ্রাম পর্যন্ত ‘খুনের রাজনীতি’র বিরুদ্ধে পদযাত্রার দিনেও মাওবাদীদের নাম নেননি মুকুলবাবু। শান্তি-উন্নয়নে সবাইকে সামিল হওয়ার ‘ইতিবাচক’ আহ্বানও জানিয়েছিলেন। আর এ দিন জঙ্গলমহলের নয়াগ্রাম, আগুইবনি, শিলদায় তিনটি জনসভায় তাঁর বক্তব্য, “কিছু লোক গ্রামে-গ্রামে পোস্টার সাঁটিয়ে ফতোয়া দিচ্ছে আমাদের সভায় যাওয়া চলবে না। সবে চার মাস আমরা রাজ্যের ক্ষমতায় এসেছি। আমরা তো কোনও তঞ্চকতা করিনি। দুর্নীতিও করিনি। তা হলে কেন আমাদের লোকজনকে খুন করা হচ্ছে?” ‘হিংসা নয় শান্তি চাই, বদলা নয় বদল চাই’ স্লোগানকে সামনে রেখে সবাইকে উন্নয়নে সামিল হওয়ার আহ্বান জানান তিনি। মুকুলবাবুর দাবি, জঙ্গলমহলের মানুষের ‘জল-জমি-জঙ্গলে’র অধিকার রক্ষার জন্যও রাজ্যের বর্তমান সরকার সচেষ্ট। জঙ্গলমহলে মাওবাদীরাও ‘জল-জমি-জঙ্গলে’র অধিকার রক্ষার লড়াইয়ের কথাই বলে। সে দিক থেকে মুকুলবাবুর এ দিনের মন্তব্য ‘তাৎপর্যপূর্ণ’। একই সঙ্গে তিনি বলেন, “আমরা আলাপ-আলোচনাতেই সব সমস্যার সমাধানে বিশ্বাসী। তবে আমাদের কোনও রকম উদারতাকে দুর্বলতা ভাবার কারণ নেই!”
|
মুখ্যমন্ত্রীকে মাওবাদীরা |
• মধ্যস্থতাকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে গিয়েই কমরেড আজাদকে হারিয়েছি। আজ যখন আপনার সরকারের মধ্যস্থতাকারীদের সঙ্গে আলোচনায় যাচ্ছি, তখনও যৌথ বাহিনী ঘিরছে আমাদের। সরকার এই মনোভাব নিয়ে চললে কী ভাবে ‘শান্তি আলোচনা’ হবে?
• কিছু দিন আগেই আমাদের উদ্দেশে লেখা খোলা চিঠিতে আপনি আমাদের ‘আদর্শবাদী’ বলে উল্লেখ করেছেন। আজ বলছেন, চোর। খুনি!
• আপনার ভাষা সংযত হওয়া দরকার। আপনার গলায় তো আজ বুদ্ধবাবুর কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছি!
|
রাজ্যের বার্তা |
মাওবাদীরা খুনোখুনি বন্ধ করুক। মধ্যস্থতাকারীরা সে কথা জানান ওদের। সরকার কিন্তু অনন্তকাল অপেক্ষা করতে পারবে না। |
|