শারদোৎসবে মাকে দেওয়ার মতো একটা নতুন শাড়িও নেই।
চোখের জলে ভাসতে ভাসতে রানি বাণেশ্বরী গৃহদেবতা মা চিন্তামণিকে বললেন, “তুমি তো আমার পর নও মা। আমি যতটুকু পারব ততটুকুতেই তোমার পুজো সারব।” নিজের পরা শাড়িই দেবীকে কেচেকুচে নিবেদন করেছিলেন রানি। সেটা ১৮৮০ সাল। সেই ধারা আজও অব্যাহত। রাঁচির উপকণ্ঠে জগন্নাথপুর গ্রামে ছোটনাগপুরের বিস্মৃত শহিদ ঠাকুর বিশ্বনাথ সহদেওয়ের পরিবারের
পুজোয় মাতৃমূর্তির সাজে নতুন শাড়ির শোভা নেই। বাড়ির বউদের পরা শাড়িই ধুয়ে ইস্ত্রি করে মায়ের পুজোয়
ব্যবহার করা হয়।
১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহের পরে সাবেক রাঁচি-সহ লাগোয়া বড়কাগড় এস্টেটের রাজা ঠাকুর বিশ্বনাথ সহদেওকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তাঁর কেল্লা এক রাত্তিরে তোপ দেগে উড়িয়ে দিয়েছিল ব্রিটিশরা। তখন কোলের শিশু কপিলনাথ, পারিবারিক শৌর্যের কয়েকটি স্মারক ও কুলদেবতা চিন্তামণির বিগ্রহকে নিয়ে কোনওমতে গুমলার জঙ্গলে পালিয়ে গিয়েছিলেন শহিদ-পত্নী রানি বাণেশ্বরী। এই চিন্তামণিই মা দুর্গা। দু’ দশক বাদে যুবকপুত্রকে নিয়ে ফিরে এসে জগন্নাথপুরে পরিবারের পুরনো ভিটেয় আশ্রয় পান রানি। দারিদ্র তখন নিত্যসঙ্গী। সেই অবস্থাতেও শুরু হয় পুজো। ওই ভিটেয় এখনও পরিবারের উত্তরপুরুষদের বাস।
বাণেশ্বরী-বিশ্বনাথের নাতি-পুতির ছেলেরা আজ সামান্য চাকুরিজীবী। তবে রাজকীয় মেজাজটা বহাল। বাহারি গোঁফ পাকাতে পাকাতে বাড়ির বড় ছেলে নবীননাথ সহদেও টালির চালের কয়েকটি ছোট ঘরে রাজপরিবারের বর্তমান ‘গড়’ বা কেল্লা দেখালেন। পাশেই রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা এইচইসি-তে অফিস যাওয়ার পথে নবীননাথের আফশোস, “দেখুন তো, বৃষ্টিতে গড়ের কয়েকটা ঘরের চাল ধসে গেল। ওখানেই অষ্টমীর যজ্ঞ হওয়ার কথা!” |
পুজোর মুখে ওই ধ্বংসস্তূপ তথা গড়ের প্রবেশদ্বারের পাশে রাখা পেল্লায় সাইজের কয়েকটি ধূলি-ধূসরিত নাগাড়া বা ধামসা। রাজপুত্রদের দাবি, এই নাগাড়া নাকি মরাঠা-বীর রঘুজি ভোঁসলের। ১৭৮০ সালে ‘বঙ্গালে’ বর্গি
হামলার আগে ছোটনাগপুরে সহদেও রাজাদের হাতে মরাঠা-যোদ্ধাদের রীতিমতো নাজেহাল হতে হয়েছিল। তখনই ওই নাগাড়া ও রাধাকৃষ্ণের কয়েকটি রুপোর মূর্তি ফেলে পালায় বর্গিরা। ১৮৫৮ সালে একমাত্র পুত্রকে নিয়ে আত্মগোপন করার সময়ে সদ্য স্বামীহারা তরুণী রানি এই পারিবারিক সম্পদ সঙ্গে নিতে ভোলেননি। অষ্টমীতে টালির ঘরের রাজপ্রাসাদে যজ্ঞ করে এখন সেই নাগাড়ার পুজো হয়। এই অঞ্চলে সাংস্কৃতিক ঐক্যের প্রতীক প্রাচীন
জগন্নাথ-মন্দিরও বিশ্বনাথ সহদেওয়ের পূর্বপুরুষ
এইনিনাথ সহদেওয়ের প্রতিষ্ঠিত। রাধা-কৃষ্ণের মূর্তি
সেখানে ঠাঁই পেয়েছে।
রাজ্যপাট না-থাকলেও রাজাদের পুজোয় আশপাশের গ্রামের পুরনো প্রজাদের ভিড়। তাঁদেরই একজন, শাখাওয়াত আলির পরিবার প্রাচীন রীতি অনুযায়ী নবমীর পুজোর ব্যয়ভার বহন করে। চিন্তামণির পুজোয় ছাগবলি অত্যাবশ্যক। কিন্তু জগন্নাথদেবের ভিটেয় রক্তপাত নিষিদ্ধ। তাই সহদেওদের বাড়ির কাছে বাসরাস্তার ও পারে আনি গ্রামে আর একটি টালির ঘরে দুর্গাবাড়ি। সপ্তমীর সকালে রুপোর ছাতায় ঢাকা মা চিন্তামণি রাজবাড়ির ঠাকুরঘর থেকে বেরোবেন। বাড়ির ছেলেদের কোলে কোলে শোভাযাত্রায় পূজাস্থলে যাবেন। বাড়ির বউ সবিতা, সুনীতা, কমলাদের পরা শাড়িতে বাঁধা কাপড়ের ডুলিতে দেবীরই প্রতীক নবপত্রিকাও পিছনে বাড়ির ছেলেদের কাঁধে থাকবে। পরম্পরা অনুযায়ী, এই শোভাযাত্রাকে পথ দেখাবেন জগন্নাথপুর গ্রামের ‘রাখওয়ালা’ তথা সহদেওদের বিশ্বস্ত প্রজা, অধুনা বন্ধু শাখাওয়াত আলি।
স্থানীয় ইতিহাসবিদদের মতে, শহিদ-পত্নী ঠাকুরাইন বাণেশ্বরীর শুরু করা এই পুজো আসলে ইতিহাসের উপেক্ষিত এক ‘দুয়োরানি’-রই পুজো। এ তল্লাটের বিভিন্ন সাড়ম্বর বনেদি-পুজোর পাশে আজও ঘরোয়া, ছিমছাম কিন্তু নিষ্ঠাময়। আর এ বাড়ির ছেলে লাল প্রবীরনাথ সহদেওয়ের কথায়, “বাণেশ্বরী দেবীর মতো নারী না-থাকলে এই পুজো কেন, আমরাই কে কোথায় থাকতাম তার ঠিক নেই!” |