মা দুগ্গা-র দশ হাত কেন? অসুরের কেন নয়?
ছোট্ট বুকুনের প্রশ্ন যেন আর শেষ হয় না। উত্তর দিতে দিতে হিমসিম বাড়ির সকলে। বাবা থেকে দিদি সকলেই এড়িয়ে যাচ্ছে দেখে বুকুন যখন মনমরা, এগিয়ে এলেন পাড়ার সদানন্দবাবু। আক্ষেপ করে বললেন, “পুজোর ইতিহাসটাই ভুলে যাচ্ছি আমরা।” তাই শুরু হল পুরাণপাঠ।
প্রবীণ প্রজন্মের অনেকেই অনুযোগ করেন, এ কালের পুজোয় আধুনিকতা থাকলেও তা যেন বড়ই কৃত্রিম, প্রাণহীন ঐশ্বর্যের প্রকাশ। যদিও পুজোর উদ্যোক্তাদের কথায়, থিম পুজো চালু হওয়ার পর থেকে বরং ঐতিহ্যের সন্ধানই হয় বেশি। আর এটা যে শুধু মুখের কথা নয়, তার প্রমাণ মিলতে চলেছে এ বারের শারদোৎসবেও। দক্ষিণের ‘বোসপুকুর পারিজাত ক্লাব’-এর পুজোপ্রাঙ্গণে চার দিকে ধানের গোলার মত দেখতে দশটি ছোট মণ্ডপ। মূলত বাঁশ ও খড় দিয়ে তৈরি মূল মণ্ডপে তুলে ধরা হচ্ছে দশভুজার আর্বিভাবের ইতিহাস।
খড় ও বাঁশের স্বাভাবিক রংই থাকছে। মণ্ডপের নানা স্থানে থাকবে গজ, দোলা, ঘটক, পেঁচা
ও গণেশের মডেল। এদের থিম “বাঁশের তালে খড়ের খেলা।” উত্তর কলকাতার দিকে মুখ ফেরালেও চোখে পড়বে বিষয়ের মিল।
যেমন-‘জোড়াসাঁকো ৭-এর পল্লি’র পুজো। এদের থিম আবির্ভাব থেকে মহিষাসুরমর্দিনী রূপের অবতারণা। মণ্ডপ থেকে প্রতিমায় থাকছে তারই প্রতিফলন।
সাবেকিয়ানা ছেড়ে এই প্রথম থিমের জগতে প্রবেশ করছে ‘নাগেরবাজার সর্বজনীন’। অ্যালুমিনিয়ামের সাত শতাধিক ঘণ্টা, আন্দামানের ৩৫০ শঙ্খ ও বৈদ্যুতিক পাইপ দিয়ে থিম ‘তন্ত্রশক্তি’কে মণ্ডপে ফুটিয়ে তুলছে এরা। আর ১২ ফুট উচ্চতার একটি পদ্মফুলের নীচে গুহার মধ্যে প্রতিমার অবস্থান। বিধাননগরের ‘ডিএল ব্লক’-এর পুজোয় আবার সাবেকিয়ানার সঙ্গে আধুনিকতার মিশেল। নাটমন্দিরের আদলে তৈরি মণ্ডপে দেবী থাকবেন মৃণ্ময়ীরূপে। মণ্ডপে পুরাণের সঙ্গে আধুনিক শিল্পকলার সহাবস্থান ফুটিয়ে তুলতে সর্বত্রই ব্যবহার হয়েছে সিসাবিহীন রং। আর ‘বি ই (পশ্চিম)’-এর পুজোয় মাতৃমূর্তির সঙ্গে ভক্তের আত্মিক যোগকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তাই তাদের থিম ‘মায়ের কাছে ফেরা’।
থিমের বিষয়ের সঙ্গে প্রকাশভঙ্গিতেও বদল ঘটেছে ‘খিদিরপুর মিলন সঙ্ঘ’-এর পুজোয়। মা দুর্গার পুজো তো এক অর্থে অন্ধকার থেকে আলোর দিশায় উত্তরণ। তাই আলোকবর্তিকা রূপে মাতৃ-আরাধনার আয়োজন হচ্ছে ‘মিলন সঙ্ঘের’ পুজোয়। বিশেষ ধরনের কাপড়, ধাতু ও কয়েক হাজার প্রদীপ সহযোগে মণ্ডপসজ্জার পাশাপাশি থাকবে মানানসই আলোকসজ্জা। বিষয়ে মিল থাকলেও ‘সিআইটি সর্বজনীন’ আলোকবর্তিকায় মাতৃ-আরাধনাকে পরিবেশন করবে ভিন্ন আয়োজনে। থাকবে লোহার পাইপ, কাচের গ্লাস, প্রদীপ ও লোহার তারের কাজে মণ্ডপসাজ। প্রতিমাতেও লোহার রিলিফ। পূর্ব কলকাতার ‘লেকটাউন অধিবাসীবৃন্দ’ এ বার আশ্রয় করেছে প্রকৃতিকে। তাই গাছের নানা অংশ দিয়েই সেজে উঠছে মণ্ডপ। ‘হাজরার ২২ পল্লি’র পুজো আবার ফিরে গিয়েছে সাবেক পুজোতে। তবে উৎসব ছাড়াও অঞ্চল পরিষ্কার রাখতে সচেতনতার প্রচারকেও বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে এই পুজো।
সাবেকিয়ানা ও আধুনিকতার এই মেলবন্ধন দেখলে সদানন্দবাবুদের আক্ষেপ মিটবে বলেই বিশ্বাস এ বছরের পুজোর উদ্যোক্তাদের। আর মনের মতো উত্তর মেলায় আপাতত বুকুনের প্রশ্নও শেষ। সে একটানা আউড়ে চলেছে, মা দুগ্গা-র দশ হাতে আছে শূল, খড়্গ, শঙ্খ, চক্র...।
|