তিনি বাড়ির মেয়ে। ছেলে-মেয়ে নিয়ে বছরে এক বার বাপের বাড়ি আসেন। নিজেদের পুকুর থাকাতেও কী সেই মেয়েকে নিরামিষ খাওয়ানো যায়? তাই সপ্তমী থেকে নবমী, তিন দিনই পুকুরের পোনা মাছ সর্ষে বাটা দিয়ে রান্না করে ভোগ দেওয়া হয় কাটোয়ার রসুই গ্রামের বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ির পুজোয়।
কাটোয়া থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে অজয় নদের পাশে রসুই গ্রাম। সেখানে ১৯০৫ সালে এই পুজোর প্রতিষ্ঠা করেন শশীভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই পুজো শুরুর দিন থেকে ‘সর্ষে বাটা মাছের ঝোল’ রান্না করে ভোগ দেওয়ার রীতি চলে আসছে। অন্য কোনও মাছ দিলে হবে না, পুকুর থেকে টাটকা রুই, কাতলা, মৃগেলের চারা পোনা দিতে হবে। তা না হলে দেবীর মুখে রোচে না, জানালেন পরিবারের সদস্যেরা। বছরে মাত্র এক বারই ঊমাকে আপ্যায়নের সুযোগ পাওয়া যায়, তাই বন্দোবস্তের কোনও খামতি রাখতে রাজি নয় বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার। |
দাঁইহাটে পণ্ডা বাড়ির পুজো মণ্ডপ। নিজস্ব চিত্র। |
পরিবার সূত্রে জানা যায়, রসুই গ্রামের হাজরা (পূর্বের পদবী চট্টোপাধ্যায়) বাড়িতে পুজোর দৌহিত্র সূত্রে নবমীর পালা ছিল বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের। মনোমালিন্যের জেরে শশীভূষণবাবু নিজে পুজো শুরু করেন। পাশাপাশি, দু’টি মন্দির। একটি হাজরা বাড়ির। অন্যটি বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের। বাড়ির বধূ পদ্মাদেবী বলেন, “বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান হাজরা বাড়িতে আগে হয়। তার পরে আমাদের বাড়িতে শুরু হয়।” দেবীর জন্য রান্না করেন তিনিই। তিনি জানান, সর্ষে, জিরে, আদা বেটে মাছ রান্না করা হয়। পিঁয়াজ বা রসুন ব্যবহার করা হয় না। প্রতি দিন দেড় থেকে দু’কিলোগ্রাম মাছের পদ রান্না করে দেওয়া হয়। এ ছাড়াও পুজো ক’দিন পাঁচ রকম অন্নভোগ (পোলাও, খিচুড়ি, গোবিন্দভোগ, সিদ্ধ চাল ও পায়েস) রান্না করা হয়। গোবিন্দভোগ চালের ভাত মাটির হাঁড়িতে রান্না করে পাথরের পাত্রে দেওয়া হয়। সপ্তমীতে সাত পোয়া, অষ্টমীতে আট পোয়া ও নবমীতে ন’পোয়া চালের রান্না করা হয়। এ ছাড়াও ন’রকম ভাজা, পাঁচ রকম সবজি দেওয়া হয়।
তবে দেবীর ভোগ রান্নার আগে ‘ছোট’দের জন্য পাঁচ রকম ভাজা, খিচুড়ি ও পায়েস দিয়ে ভোগ দেওয়া হয়। বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ির সদস্য আশিস বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “একে বলে বাল্য ভোগ। দুপুরে দেবীর ভোগ হয়। কিন্তু কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী তো ছোট। তাই ওদের জন্য তাড়াতাড়ি রান্না করে দেওয়া হয়।” তিন দিন মাছ খাওয়ার পরে দশমীতে অবশ্য বাসি লুচি খেয়ে শ্বশুরবাড়ি রওনা হন ঊমা। কেন এমন রীতি, তা অবশ্য জানাতে পারেননি পরিবারের সদস্যেরা। অন্য দিকে, দাঁইহাটের পণ্ডা বাড়িতে দেবী দশমীর দিন পান্তা ভাত খান। সঙ্গে থাকে চিংড়ি দিয়ে পুঁই ডাঁটার চচ্চড়ি। পরিবার সূত্রে জানা যায়, ৩২০ বছর আগে এই পুজো শুরু হয়। আগে নিরামিষ ভোগেরই রীতি ছিল। ছ’পুরুষ আগে দশমীতে চিংড়ির রেওয়াজ চালু হয়। কথিত আছে, এক বৃদ্ধা দশমীর দুপুরে মাছ খাওয়ার কথা জানিয়েছিলেন। তার পরের বছর থেকে চিংড়ি ভোগের রীতি চালু হয়। পরিবারের সদস্যদের ধারণা, দেবী ছদ্মরূপে এসে মনের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। |