এ ঘোর কলিতে ইন্টারনেটেই প্রেম বন্ধুত্ব শেয়ারিং কেয়ারিং,
আবার বিচ্ছেদের যন্ত্রণা, কাদা-ছোড়াছুড়ি, গালাগালি। সব কিছুর
জন্যই নিজেকে প্রস্তুত রাখতে হবে। এ খেলার শর্তই এই।
সঞ্চারী মুখোপাধ্যায় |
তুমুল দোষারোপ চলছে বেঙ্গালুরুর আই আই এম-এর ছাত্রী মালিনী মুর্মুর আত্মহত্যা নিয়ে। অভিযুক্ত তার প্রেমিক সম্পর্কে ইতি টানার দায়ে। তার বিরুদ্ধে খুনে প্ররোচনা দেওয়ার মামলা করা হয়েছে। ব্যাপারখানা সহজ নয়। মালিনীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পরে প্রেমিকটি তার সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইটে ফলাও করে লিখেছিল, সে কত বড় মুক্তি পেয়ে কত সুখে রয়েছে। তার পর দিন মালিনীকে তার ঘর থেকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়, গলায় ফাঁস ছিল। ধরে নেওয়া হচ্ছে, পাষণ্ড প্রেমিক ফলাও করে তাদের ‘ব্যক্তিগত’ খবরটি ফেসবুকে জানিয়ে দেওয়ার লজ্জাটা আর সে সহ্য করতে পারেনি। এই অনুমান সত্য হোক বা না হোক, প্রেমিকটি অত্যন্ত অন্যায় করেছে। ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে জনসমক্ষে কাউকে এ ভাবে আঘাত করার অধিকার কারও থাকতে পারে না। আমার নিকটজনের ওপর অধিকার, ভালবাসা, বৈরিতা, ঘেন্না আমার ব্যক্তিগত সম্পত্তি হতে পারে না, যা আমি এক-ইন্টারনেট লোকের সামনে নিলামে চড়াতে পারি।
ধরা যাক মধ্য আমেরিকার এক শহরের কাহিনি। হাজার পাঁচেক লোকের বাস, সবাই সবাইকে চেনে। বেশ কিছু পুরনো লোকজন রোজ সকালে একসঙ্গে বসে ‘ডি’স প্লেস’ বলে এক জায়গায়। গপ্পোগুজব যত না হয়, পরনিন্দা-পরচর্চা হয় অনেক বেশি। ইদানীং দেখা যাচ্ছে সেখানে লোকজন আর প্রায় আসেই না। বেশির ভাগ লোক ‘মাউন্টেন গ্রোভ ফোরাম’ নামের একটা সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইটের খুব ভক্ত হয়ে পড়েছে। কারণ যত কেচ্ছা সেখানেই মজুত আছে। এবং সেই সাইটে নাম না করে কিন্তু যথেষ্ট হিন্ট দিয়ে লেখা হয়েছে যে, ডি’স প্লেস-এর যে রাঁধুনি সে নাকি এডস আক্রান্ত একটি বেশ্যা। খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছে খবরটি সর্বৈব মিথ্যে। মেয়েটি কান্নাকাটি করে চলেছে, এমনকী আত্মহত্যার কথাও ভেবেছিল।
কিংবা, নাইজিরিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডরমিটরিতে একটি মেয়েকে পাঁচজন পুরুষ পর পর ধর্ষণ করছে এই ইন্টারনেট ক্লিপটি সাড়া ফেলে দিয়েছে সর্বত্র। দশ মিনিটের এই ক্লিপ-এ দেখা যায় মেয়েটি পাগলের মতো চেঁচাচ্ছে, ‘আমায় তোমরা মেরে ফেলো’। কিন্তু তার বদলে সে ধর্ষিত হয়। নাইজিরিয়ার এন জি ও’রা বলছে, তারা এই নিয়ে প্রতিবাদ জারি রাখবে। তাদের আন্দোলন আরও শক্তিশালী করবে ক্লিপটি, প্রমাণ হিসেবে কাজ করবে যে নাইজিরিয়ার মতো দেশে প্রতিনিয়ত কত ধর্ষণ হয় আর সে ব্যাপারে সরকার কতটা উদাসীন। এই প্রচার একটা বড় ন্যায় প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করবে। |
কিন্তু ওই মেয়েটার কী হবে? ধর্ষণের অত্যাচার, মানসিক যন্ত্রণা সব যদি বা সে কাটিয়েও উঠত, তার সবচেয়ে নৃশংস, অসহায় মূহূর্তগুলো পাবলিকের হয়ে গেল। হয়তো কারও সঙ্গে রাস্তায় দেখা হলে সে ভাববে মেয়েটির স্তনটা তো এ-রকম, কিংবা যোনিটা তো সে-রকম। আর কেউ যদি তা না ভাবেও, তা হলেও মেয়েটা ভাববে, রাস্তায় হাঁটা প্রতিটি লোক তার মাংস খুবলে নেওয়ার দৃশ্যটা দেখেছে, হাতে স্যান্ডউইচ আর কফি নিয়ে। কেউ দেখার সময় মুখে ‘প্লিচ’ শব্দটি করা ছাড়া অন্য উদ্যোগ নিয়েছে কি? কীসের বিনিময়ে ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হবে? এক জনের প্রতি একটা নৃশংস অন্যায়ের ওপর ভর করে?
আশ্চর্য! কাঁধে অন্যের ভাল কিংবা মন্দের গুরুদায়িত্ব না থাকা সত্ত্বেও এঁরা তথ্যের প্রতি দায়বদ্ধ থাকার দায়ে অন্যের ব্যক্তিগত যন্ত্রণা, অন্যের ব্যক্তিগত অপমান, অন্যের ব্যক্তিগত জীবন পাবলিকের সামনে নিলাম করেছেন। অথচ সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলো তো ব্যক্তিগত (সেটা আমার না অন্যের, সেটাই যা একটু গুলিয়ে যায়) তথ্যেই ভরপুর। কারও পটি পেয়েছে, কেউ গাছে জল দিল, কারও জ্যাঠার এখুনি হার্ট অ্যাটাক করল ক্ষণে ক্ষণে ব্যক্তিগত আপডেট। কিছু লোক তো এই সব সাইটকে ভরসা করে বেঁচে অবধি রয়েছে। সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইটের আপডেট আর প্রশংসা আর সহানুভূতি তার জীবনকে আলোড়িত করে রাখে। বেঁচে থাকার পথ দেখায়। সত্যি, এমন বন্ধু থাকতে কেনই বা মালিনী মুর্মুর প্রাক্তন প্রেমিক অসহ একটা সম্পর্ক থেকে মুক্তি পাওয়ার কথা ফলাও করে বলবে না? কত বন্ধু হয় তো কনগ্র্যাটস ডুড, কেয়া বাত, হার্টিয়েস্ট কনগ্র্যাচুলেশন এ সব জানিয়েছে। তার মুক্তি পাওয়াটা তার কাছে জাতীয় স্বাধীনতার মতোই গুরুত্ব পেয়েছে হয়তো। সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইট-এর বন্ধুরা তো তার বন্ধু। সে শেয়ার করবে না?
কথাটা হল, কী শেয়ার করবে? কতটা? নিজের কথাটা যদি স্রেফ নিজের কথাই হয়, চেঁচিয়েমেচিয়ে সাত তলা ছাদ থেকে বলাই যায়। কিন্তু ‘নিজের কথা’য় হামেশাই অন্যের অনুভূতি জড়িয়ে থাকে। কেউ যদি বলে, আমি অঙ্কে একশো পেয়েছি কিন্তু ও অঙ্কে শূন্য পেয়েছে, শূন্য পাওয়া ছেলেটার খারাপ লাগবে না? নিজের সাফল্যকে সেলিব্রেট কর, কে বারণ করেছে? কিন্তু অন্যের অসাফল্যকে প্রতিটি গলিতে, প্রতিটি চায়ের দোকানে বিজ্ঞাপিত করার দরকার ছিল কি? ভালবাসার মধ্যেও একটা সাফল্য থাকে আর প্রেম ভেঙে যাওয়ার মধ্যে থাকে হেরে যাওয়া, বিশেষত যে ফেলুবাবু, তার কাছে। তা-ই আমার কাছে যা নিষ্পাপ তা অন্যের জীবনে অভিশাপ ডেকে আনতেই পারে। জাস্ট ফর ফান, জাস্ট ফর ইনফরমেশন, জাস্ট লাইক দ্যাট এই কথাগুলো আমরা বড় হেলায় বলি। এইখানে ‘জাস্ট’ কথাটার প্রতি একটু মন দিলে, ব্যক্তিগত-র মানেটা বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
মার্কিন শহরের কমিউনিটি আর নাইজিরিয়ার ধর্ষিতা মেয়েটির ক্লিপ যারা ইন্টারনেটে প্রচার করেছে, তারা কি অন্যের সাংঘাতিক ক্ষতি করব বলে করেছে? নাইজিরিয়ার এন জি ও’রা তো বলছে, একটা পরবর্তী আন্দোলনের পদক্ষেপ হিসেবে এই প্রচার অত্যন্ত শক্তিশালী। কিন্তু কীসের বিনিময়ে এই আন্দোলনের ভিত প্রস্তুত হচ্ছে? এক জনের আত্মা-নিংড়োনো ক্কাথ দিয়ে? তার ব্যক্ত বা অব্যক্ত যন্ত্রণা বিলিয়ে সংগ্রহ করা হবে সই?
অনেক হল নীতি আর নৈতিকতা। এ বার হার্ড কোর বাস্তব। ইন্টারনেট না থাকলে হয়তো ধর্ষিতা মেয়েটির যন্ত্রণাটা কেবল তারই থাকত, কয়েক কোটি লোকের কাছে প্রদর্শনী হয়ে যাওয়ার লাঞ্ছনাটা তাকে সহ্য করতে হত না। ইন্টারনেট যেমন কয়েকশো যোজন এগিয়ে দিয়েছে আমাদের, তেমনই ‘ব্যক্তিগত’কে দলেপিষে মণ্ড পাকিয়ে দিয়েছে। এ আসলে একটা পাঁচ বছরের ছেলের হাতে এ কে ফিফটি সিক্স ধরিয়ে দেওয়ার মতোই। প্রাণ সব সময় হাতে। আমি সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইটে নেই, আমি তো কারও সম্বন্ধে কিছু বলিনি, আমি তো কারও খারাপ করিনি এ সব কোনও তাগড়া কারণ নয়। এ সব যুক্তির একটাই উত্তর তুমি দিনযাপন করছ ইন্টারনেট-যুগে। অতএব তুমি যখন তখন বেআব্রু হতে পারো। ইন্টারনেট জমানায় ‘ব্যক্তিগত’র সমনাম হল ‘উন্মোচিত’। জীবন এখন খোলা পাতা। এক একটা ক্লিকে হাজির তামাম দস্তাবেজ। এই যে হ্যালালালা সমর্পণ, কিছুই কাহারও ব্যক্তিগত নহে এ আগে হলে হয়তো বা বঙ্গে কমিউনিজম বেঁচে যেত।
কেবল মালিনী নয়, আমি আপনি দাদা বুড়োজ্যাঠামশাই সেক্সি মেয়ে ভীতু ছেলে উদ্ধত আঁতেল, সবাই ইন্টারনেটের কাছে ‘ব্যক্তিগত’ গচ্ছিত রেখেছি। আমার ‘ব্যক্তিগত’ কখন, কার, কোন ইচ্ছের বশে ‘সব্বার’ হয়ে যাবে, কেউ জানে না। আর তেমন কাণ্ড ঘটতে পারে, এই আশঙ্কায় বন্ধু, প্রেমিক, পাড়াতুতো কাকু, সবার সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে যদি চিলেকোঠায় খিল দিতে হয়, সেটা তো জীবন নয়।
অতঃ? শিখতে হবে পাত্তা না দেওয়া। ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে হবে নীচতা-ঈর্ষা-ঘৃণা-সোশালনেটওয়ার্কিংসাইট। এ ঘোর কলিতে ইন্টারনেটেই প্রেম বন্ধুত্ব শেয়ারিং কেয়ারিং, আবার বিচ্ছেদের যন্ত্রণা, কাদা-ছোড়াছুড়ি, গালাগালি অল ইন দ্য গেম। সব কিছুর জন্যই তৈয়ার থাকতে হবে। এ খেলার শর্তই এই।
আমরা কি বলতে পারি গোলটা নেব আর ফাউলটা নেব না? |