বিশ্ব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ভারত যে শুধু সরব নয়, এ বিষয়ে তার ভূমিকাও অগ্রণী, আজ রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভার বক্তৃতার ছত্রে ছত্রে সেটাই বুঝিয়ে দিলেন মনমোহন সিংহ। সেই সঙ্গে রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের সংস্কার ও সম্প্রসারণের কথা বলে প্রকারান্তরে ভারতের স্থায়ী আসনের দাবি নথিভুক্ত করে রাখলেন।
সন্ত্রাস প্রশ্নে পাকিস্তানকে চাপে রাখার লক্ষ্য নিয়েই এ বার রাষ্ট্রপুঞ্জে এসেছেন মনমোহন। ভারতে পাক সমর্থনপুষ্ট সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আমেরিকাকে সক্রিয় করাও তাঁর উদ্দেশ্য। সেই লক্ষ্যে আজ তাঁর বক্তৃতায় মনমোহন ফের বলেছেন, “সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অবিরাম যুদ্ধ চালাতে হবে। বেছে বেছে জঙ্গি গোষ্ঠী বা সন্ত্রাস পরিকাঠামোর উপরে আঘাত হানলে চলবে না। সব রকম সন্ত্রাসের বিরুদ্ধেই লড়তে হবে।” অর্থাৎ বিশ্বের অন্যত্র সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কঠোর হলেও আমেরিকা যে ভাবে পাকিস্তান সম্পর্কে নরম মনোভাব নেয়, তা যে চলতে পারে না, সে কথা আবার জোরের সঙ্গে বুঝিয়ে দিল দিল্লি।
প্রধানমন্ত্রী যখন এ কথা বলছেন, ঠিক তখন পাকিস্তান সম্পর্কে সরাসরি অভিযোগ এনেছে আমেরিকা। আমেরিকার বক্তব্য, কাবুলে মার্কিন দূতাবাসে তালিবান হামলার পিছনে পাকিস্তানের ভূমিকা প্রমাণিত। এমনকী পাক চররা মার্কিন দূতাবাসে হানা দিতে চেয়েছিল বলেও ওবামা প্রশাসন জানিয়েছে। হাক্কানি গোষ্ঠীর সঙ্গে আইএসআইয়ের যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে, তা-ও দ্ব্যর্থহীন ভাবে জানিয়েছেন মার্কিন জয়েন্ট চিফ অফ স্টাফের চেয়ারম্যান অ্যাডমিরাল মাইক মুলেন। আফগানিস্তানে বুরহানুদ্দিন রব্বানির হত্যার প্রসঙ্গ তুলেও আজ পরোক্ষে পাকিস্তানকে চাপে রেখেছেন মনমোহন। সেই সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ায় তাদের এক ঘরে করতে তুলে ধরেছেন সন্ত্রাস প্রশ্নে ভারত-বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সহযোগিতার কথা। তিস্তা চুক্তি না হওয়া সত্ত্বেও যার উল্লেখকে তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, “দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা সংক্রান্ত সহযোগিতার ক্ষেত্রে আশাব্যঞ্জক উন্নতি দেখা গিয়েছে। যেমন, ভারত-বাংলাদেশ সহযোগিতা। যার ফলে দুই দেশই উপকৃত হচ্ছে।” বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের উন্নতি স্বাভাবিক কারণেই পাকিস্তানের না-পসন্দ। আন্তর্জাতিক মঞ্চে দিল্লি-ঢাকা সৌহার্দ্যের কথা বলে কৌশলে ইসলামাবাদকে চাপে রাখলেন মনমোহন। |
এর আগে অটলবিহারী বাজপেয়ীর আমলেও ভারত সন্ত্রাস নিয়ে সরব হত। কিন্তু পাকিস্তানকে সরাসরি আক্রমণ করত না। আর প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার দিনই বা তার পরের দিন বক্তৃতা দিতে গিয়ে পারভেজ মুশারফ, নওয়াজ শরিফ বা তার আগে বেনজির ভুট্টো সরাসরি ভারতের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলতেন। মুশারফ তো এক বার গুজরাতের দাঙ্গা নিয়ে মুখ খুলে, ভারতের মুসলমানদের জন্য অশ্রু বিসর্জন করে বিতর্ক তৈরি করে ফেলেছিলেন। পাক প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানি এ বার রাষ্ট্রপুঞ্জে আসেননি। তার বদলে রাষ্ট্রপুঞ্জে বক্তৃতা দেবেন বিদেশমন্ত্রী হিনা রব্বানি খার। নিয়ম অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রীদের বক্তৃতা শেষ হয়ে যাওয়ার পরে বিদেশমন্ত্রীরা বক্তৃতা দেবেন। তাই মনমোহন চলে যাওয়ার পরে হিনা রব্বানির সুযোগ আসবে। কিন্তু তাঁর বক্তব্যের গুরুত্ব স্বাভাবিক ভাবেই কম হবে।
পাশাপাশি, মাইক মুলেনের বক্তব্যে বিপাকে পড়েছে ইসলামাবাদ। আমেরিকা বুঝতে পারছে, তালিবান দমনের জন্য পাকিস্তানকে চাপে রাখতে হবে। সন্ত্রাস প্রশ্নে পাকিস্তানকে ঘিরে ভারত ও আমেরিকার মধ্যে যে ঐকমত্য তৈরি হয়েছে, তা স্পষ্ট। যেটা এই মুহূর্তে দিল্লির বড় প্রাপ্তি।
তবে ইরান, প্যালেস্তাইন বা লিবিয়া নিয়ে ভারত আবার আমেরিকার অবস্থানের বিরোধী। আজ লিবিয়ার নাম না করলেও মনমোহন বলেন, “আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আইনের শাসন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাইরে থেকে সামরিক শক্তির জোরে কোনও সমাজকে বদলানো উচিত নয়। সব দেশের মানুষেরই নিজেদের ভবিষ্যৎ স্থির করার অধিকার আছে।” স্বাধীন, সার্বভৌম প্যালেস্তাইন রাষ্ট্র গঠনের সংগ্রামকে যে ভারত সমর্থন জুগিয়ে যাবে, সে কথাও ফের স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দিয়েছেন মনমোহন।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতের এই ক্রমপ্রসারিত ভূমিকার নিরিখেই নিরাপত্তা পরিষদের সম্প্রসারণ গুরুত্বপূর্ণ। ব্রাজিল, জাপান ও জার্মানিকে সঙ্গে নিয়ে পরিষদের স্থায়ী আসনে দাবি জানাচ্ছে ভারত। মনমোহন আজ বলেন, “আমাদের আরও শক্তিশালী এবং কার্যকরী রাষ্ট্রপুঞ্জ দরকার। সে জন্য নিরাপত্তা পরিষদের সংস্কার এবং বিস্তার একান্ত জরুরি।”
বিশ্বজোড়া আর্থিক সঙ্কট নিয়েও আজ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, “বিশ্ব অর্থনীতি সঙ্কটে। ২০০৮ সালের সঙ্কটের সময় যে দাওয়াই দেওয়া হয়েছিল, তার ফল এখনও মেলেনি। উল্টে অনেক দিক দিয়ে সঙ্কট আরও গভীর হয়েছে।” মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জাপানে আর্থিক মন্দার ফলে চাপের পাশাপাশি উন্নতিশীল দেশগুলিকে যে মূল্যবৃদ্ধির ধকলও সইতে হচ্ছে, সে কথাও আজ মনে করিয়ে দিয়েছেন মনমোহন। |