আজ বসছেন প্রণবের সঙ্গে
কূটনীতি ভুলে ঘরের দ্বন্দ্বে ব্যস্ত মনমোহন
মাথায় উঠেছে কূটনীতি। দেশের মাটিতে পা রাখার আগে এখন প্রণব-চিদম্বরম বিতর্ক মিটিয়ে ফেলতে মরিয়া প্রধানমন্ত্রী।
আর সেটা করতে গিয়ে রবিবার সকালে (ভারতীয় সময়) প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলোচনায় বসছেন মনমোহন সিংহ। টুজি স্পেকট্রাম বণ্টন নিয়ে কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের নোট প্রকাশ্যে আসার পর থেকে রোজই বিরোধীরা চিদম্বরমের মুণ্ডপাত করছেন। ইস্তফা চাইছেন। এই অবস্থায় চিদম্বরমের প্রতি আস্থা জানানোর পাশাপাশি মনমোহন চাইছেন, প্রণববাবুও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সমর্থনে মুখ খুলুন। কিন্তু প্রণববাবু এখনও এমন কিছু বলতে রাজি নন। বস্তুত, দেশে ফেরার আগে এ নিয়ে মুখ খুলবেন না বলেই জানিয়ে দিয়েছেন তিনি। অথচ সনিয়া গাঁধী চাইছেন, যত দ্রুত সম্ভব এই বিতর্ক মিটিয়ে ফেলা হোক। তাই জট কাটাতে কাল নিউ ইয়র্কেই অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বসছেন মনমোহন। প্রণবকে ছাড়া যে তাঁর পক্ষে সরকার চালানো সম্ভব নয়, সে কথা তিনি এর মধ্যে ঘনিষ্ঠমহলে কবুলও করেছেন। আজ বিরোধীদের বক্তব্য নস্যাৎ করতে গিয়েও বলেন, “আমার মন্ত্রীদের প্রতি আমার পূর্ণ আস্থা আছে।” এই কথা থেকেই স্পষ্ট, এখন প্রণববাবুর প্রতিও আস্থা জানাচ্ছেন তিনি।
সবে মিলে
রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভায় বক্তৃতা দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। শনিবার।
এবং একই সঙ্গে লক্ষ্যণীয়, রাষ্ট্রপুঞ্জে বক্তৃতার মঞ্চ থেকে নেমেই কিন্তু তাঁকে ফিরতে হচ্ছে দেশীয় রাজনীতির প্রসঙ্গে। অর্থাৎ, আপাতত স্বর্গে যাওয়া ঢেঁকির মতো অবস্থা মনমোহন সিংহের।
এর আগে ঢাকা সফরে গিয়েও দেশীয় রাজনীতির ছায়া থেকে বেরোতে পারেননি প্রধানমন্ত্রী। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তিস্তা চুক্তির বিরোধিতা করায় গোটা বাংলাদেশ সফরেই তার ছায়া পড়েছিল। এ বার রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভায় এসেও তথৈবচ। অথচ দেশের যাবতীয় বিতর্ক থেকে বেরোতে, সে সব থেকে মানুষের দৃষ্টি ঘোরাতেই দীর্ঘদিন পরে তাঁর রাষ্ট্রপুঞ্জ সফর। এর পর নভেম্বরেও সার্ক, জি-২০ সম্মেলন মিলিয়ে তাঁর ঠাসা বিদেশ সফরসূচি। ইরানের প্রেসিডেন্টও তাঁকে সে দেশে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
কিন্তু যতই ঘর থেকে বেরোতে চান তিনি, ঘরের রাজনীতিতেই আটকে যান বারে বারে।
প্রণব মুখোপাধ্যায় আজ রাতে ওয়াশিংটন থেকে নিউ ইয়র্কে ফিরছেন। এখানে এসে পার্ক সেন্ট্রাল হোটেলে উঠবেন তিনি। ভারতীয় সময় অনুযায়ী রবিবার সকালে নিউ ইয়র্ক প্যালেসে, যেখানে মনমোহন উঠেছেন, সেখানে দু’জনের বৈঠক হবে। তার পর বিকেলের বিমানে নয়াদিল্লি ফিরে যাবেন প্রণব। প্রধানমন্ত্রী এখান থেকে সোমবার সকালে রওনা দিচ্ছেন। ফেরার পথে ফ্র্যাঙ্কফুর্টে এক রাত কাটিয়ে তিনি দিল্লি যাবেন। মঙ্গলবার দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী-প্রণব, দু’জনেই থাকবেন। তা হলে এত তাড়াহুড়ো কেন?
কারণ একটাই। মনমোহন বুঝতে পারছেন, প্রণব বনাম চিদম্বরম বিতর্ক এত সহজে মিটছে না। দ্বিতীয় ইউপিএ-র যা পরিস্থিতি, তাতে এই সঙ্কট অনেক গভীরে। প্রধানমন্ত্রী এক শীর্ষ ক্যাবিনেট মন্ত্রীর কাছে মন্তব্য করেছেন, ‘আমি প্রণববাবুকে ছাড়া সরকার চালাতে পারব না।’ সনিয়াও একই বার্তা দিতে চেয়েছেন যে, গোটা বিষয়টি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মিটিয়ে ফেলাই ভাল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সচিবলায়ের এখন দুর্বলতা হল, সেখানে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা বলতে একমাত্র শিবশঙ্কর মেনন। কিন্তু তিনি জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা। সেই অর্থে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা বলতে কেউ নেই। প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি টি কে এন নায়ার আছেন। কিন্তু তিনি বিদায়ের মুখে। বহু যুগ্মসচিব বদলি হয়ে গিয়েছেন। অনেক পদ খালি। ১ অক্টোবর পুলক চট্টোপাধ্যায় দায়িত্ব গ্রহণ করার পরেই সব নতুন করে সেজে উঠবে। তার ফলে এক দিকে সনিয়া গাঁধীর সঙ্গে সরকারের যোগসূত্র গভীর হবে বলে মনে করা হচ্ছে। পাশাপাশি বিভিন্ন মন্ত্রকের মধ্যে বিবাদ মেটানোও সহজ হবে।
রাষ্ট্রপুঞ্জের সদর দফতরে ইরানের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমেদিনেজাদের সঙ্গে
পার্শ্ববৈঠকে মিলিত হওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। শনিবার।
কিন্তু এখনকার বিতর্ক মিটবে কী ভাবে? বিষয়টি ধামাচাপা দিতে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় থেকে বলা হচ্ছে, অর্থ মন্ত্রকের ওই চিঠি একটা ‘ব্যাকগ্রাউন্ড নোট’। তার থেকে বেশি কিছু নয়। প্রধানমন্ত্রীর দফতর বলছে, স্পেকট্রাম বণ্টন নীতিতে যে কোনও দুর্নীতি ছিল না, তার জন্য প্রধানমন্ত্রী সে সময় একটা বিস্তারিত নোট তৈরি করতে চেয়েছিলেন। বিভিন্ন মন্ত্রক থেকে তথ্য নেওয়া হচ্ছিল। সে জন্যই অর্থ মন্ত্রক থেকে ওই নোট পাঠানো হয়েছিল। তা-ও একেবারে ডেপুটি সেক্রেটারি স্তর থেকে নোটটি এসেছিল। তা নিয়ে এত হইচইয়ের কিছু নেই। কিন্তু বাস্তব হল, নিলামের মাধ্যমে স্পেকট্রাম বণ্টন করা উচিত ছিল বলে ওই নোটে প্রণববাবুর মন্ত্রক যে মত ব্যক্ত করেছিল, তা খণ্ডন করে প্রণববাবু কোনও বিবৃতি দেননি। ফলে বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গিয়েছে। ফলে বিরোধীদের অভিযোগ জোরদার হয়ে গিয়েছে। তা ছাড়া, প্রণববাবু এক বারও বলেননি যে অর্থ মন্ত্রকের নোটটি ভুল। অন্য মন্ত্রীরা যে ভাবে চিদম্বরমের সমর্থনে এগিয়ে এসেছেন, সে ভাবেও তিনি চিদম্বরমের সমর্থনে এগিয়ে আসেননি।
মনমোহন বুঝতে পারছেন, প্রণববাবু যদি অসন্তুষ্ট হন, তা হলে সরকার চালানোই কঠিন হয়ে যাবে। তাই আগামিকালের বৈঠক তাৎপর্যপূর্ণ। স্পেকট্রাম বণ্টন নীতিতে যে কোনও দুর্নীতি ছিল না, তা সুস্পষ্ট করে দেওয়ার দায়িত্ব মনমোহন প্রণববাবুকেই দিতে চাইছেন। যাতে তিনি দিল্লি ফিরে বিবৃতি দিয়ে বা সাংবাদিক বৈঠক করে বিষয়টি স্পষ্ট করে দেন এবং চিদম্বরমকে সমর্থন করেন। কিন্তু তাতে প্রণব এখনও রাজি নন।
প্রণববাবু নোটটি ফাঁস করেছেন কি না, তাই নিয়েও সন্দেহের পরিবেশ তৈরি হচ্ছিল। তার কারণ হচ্ছে, তথ্যের অধিকার আইনে যিনি এ বিষয়ে জানতে চেয়েছিলেন, তিনি প্রধানমন্ত্রীর দফতর ও অর্থ মন্ত্রকের মধ্যে আদানপ্রদান হওয়া সমস্ত চিঠি না চেয়ে নির্দিষ্ট তথ্য জানতে চেয়েছিলেন। ফলে অর্থ মন্ত্রকের দিকেই সন্দেহের তির। কারণ, ওই চিঠি যে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে গিয়েছে, তা বাইরের লোক জানল কী করে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সেখানে অর্থ মন্ত্রকের পাল্টা বক্তব্য, প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় থেকেও বিষয়টি ফাঁস হতে পারে। বিজেপি নেতা বিবেক গর্গ, যিনি এই তথ্য জানতে চেয়ে আবেদন করেছিলেন, তাঁর বক্তব্য, কোনও বিশেষ চিঠি নয়। তিনি গত জুন থেকে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের সঙ্গে অর্থ মন্ত্রকের আদানপ্রদান নিয়ে জানতে চেয়েছিলেন। তাতে পিএমও এই নোটটির কথা জানায়। ফলে সন্দেহ দেখা দিয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের কোনও অফিসারও এই কাজ করতে পারেন। সরকারের সঙ্কট বাড়াতে এর পিছনে বিজেপির হাতও থাকতে পারে। প্রণবের দিকে সন্দেহের তির নিয়ে গিয়ে মন্ত্রীদের পারস্পরিক সম্পর্ক জটিল করার ষড়যন্ত্র রয়েছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। শার্লক হোমসের গল্পের নিয়ম, কোনও অপরাধের ফলে লাভবান কে, আগে তা খতিয়ে দেখা। সেই যুক্তিতে এখানে প্রণববাবুর কোনও লাভ হয়নি। যে প্রণববাবু ঐকমত্য তৈরির কাজ করেন, তিনিই এখন একঘরে। উল্টো দিকে, যে চিদম্বেরমের জনসংযোগ খুব খারাপ, তাঁর পক্ষেই সকলে বলতে শুরু করেছে। প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় সূত্রে তাই বলা হচ্ছে, পুরো বিষয়টি তদন্ত করে দেখা দরকার।
আস্থা অর্থমন্ত্রীতেও
যুক্তি, পাল্টা যুক্তির এই লড়াই চলছে। বিভিন্ন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও এখন নিউ ইয়র্কে। আনন্দ শর্মা, ফারুক আবদুল্লা, গুলাম নবি আজাদ রয়েছেন। জয়রাম রমেশ ঘুরে গিয়েছেন। রয়েছেন যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়াও। আর মজা হচ্ছে, সব কিছুর ভিড়ে হারিয়ে গিয়েছে মনমোহনের মূল উদ্দেশ্য। কোথায় দেশের বিতর্ক পিছনে ফেলে কূটনীতি নিয়ে মাথা ঘামাবেন, গোটা বিশ্বে যখন আবার মন্দার ছায়া ঘনাচ্ছে তখন নিজের প্রিয় বিষয় অর্থনীতি নিয়ে নতুন দিশা দেখাবেন, আন্তর্জাতিক মহলকে দেখাবেন, ভারতের অর্থনীতি এর মধ্যেও কতটা শক্ত ভিতের উপরে দাঁড়িয়ে, তা নয়। উল্টে ঘরের সঙ্কট মেটাতেই সময় যাচ্ছে তাঁর। রাষ্ট্রপুঞ্জে তাঁর বক্তৃতা চলে গিয়েছে দ্বিতীয় সারিতে। গুরুত্বের বিচারে এক নম্বর জায়গাটি নিয়ে ফেলেছে সরকারে অন্তর্দ্বন্দ্ব মেটাতে প্রণববাবুর সঙ্গে বৈঠক। ভারতের দুই মন্ত্রীর বিবাদের ফলে অন্তর্জাতিক মঞ্চেও যে সুনাম নষ্ট হচ্ছে দেশের!
অবস্থা দেখে এক শীর্ষ মন্ত্রী বলছিলেন, “দ্বিতীয় ইউপিএ-সরকার এখন এমন একটা ফ্লপ সিনেমা, যার প্রথমার্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পর দর্শকরা জানতে চাইছেন, দ্বিতীয়ার্ধটা কখন শেষ হবে?”
মনমোহন আজ তাই একেবারেই খুশি মানুষদের এক জন নন। পরশু, ২৬ সেপ্টেম্বর তাঁর জন্মদিন। সে দিন তিনি বিমানেই থাকবেন। বিমানেই তাঁর জন্মদিন পালন হবে। কিন্তু ২৫ তারিখ, রবিবারটি তিনি চেয়েছিলেন তাঁর নিউ ইয়র্ক-বাসিনী কন্যা অমৃত সিংহের সঙ্গে কাটাতে, যিনি আজ রাষ্ট্রপুঞ্জে বাবার বক্তৃতা শুনতে এসেছিলেন। কিন্তু সেই ছুটি কাটানোও এখন কপালে নেই মনমোহনের। রবিবারটি যে নির্ধারিত হয়ে আছে প্রণববাবুর সঙ্গে বৈঠকের জন্য!
ঢেঁকি যে স্বর্গে গেলেও ধান ভানে, তা এখন প্রতি পদে বুঝতে পারছেন মনমোহন সিংহ।

ছবি: পি টি আই



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.