যে পুজোয় প্রতিষ্ঠা পায় প্রজার অধিকার
ক দিকে প্রজাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা, অন্য দিকে স্বাধীনতা সংগ্রাম এই দুই-ই জড়িয়ে রয়েছে পটাশপুরের গোপালপুর চৌধুরীবাড়ির ঐতিহ্যমণ্ডিত দুর্গাপুজোয়।
মুঘল আমলের শেষ দিকে অমর্ষির রাজা অমর সিংহের দরবারের কর্মী ছিলেন হরিদাস পট্টনায়ক। পরে তিনি অমর্ষি পরগনার গোপালপুরে জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন। ইংরেজ আমলে চৌধুরী উপাধিও পান। উত্তরপুরুষরা তাই ব্যবহার করছেন। এই বংশের তৃতীয় পুরুষ নন্দলাল চৌধুরী সন্তান কামনায় জগজ্জননী দুর্গার আরাধনা শুরু করেন। তিনি পুত্রসন্তান লাভ করলে দেবীমহিমার ব্যাপ্তি ঘটে। আজও চৌধুরীবাড়ির দুর্গার কাছে মানত করার পরম্পরা চলে আসছে। রয়েছে আরও কিছু প্রথা-পরম্পরা। রাজদরবারে কাজের সূত্রে প্রজা শোষণের নিষ্ঠুর চেহারাটা কাছ থেকে দেখেছিলেন হরিদাসবাবু। তাই জমিদার হরিদাসবাবু ছিলেন প্রজাবান্ধব। উত্তরপুরুষরাও সেই ধারা ভাঙেননি। বরং দেবীমহিমার জেরে দূরদূরান্ত থেকে আসা মানতকারীদের পুজোর ক’দিন ঠাঁই দিতে গিয়ে তাঁরা ভুলে যেতেন রাজা-প্রজার ভেদাভেদ। চৌধুরীবাড়ির আঙিনা আপন হয়ে উঠত জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কেলেঘাই নদীর দুই পারের মানুষের কাছে।
পরিবারের সদস্য সতীরঞ্জন চৌধুরী জানালেন, পুজোর প্রবর্তক নন্দলাল চৌধুরী নিজে মোক্ষদায়িনী দেবীর মূর্তি গড়ে পুজো করেছিলেন। কয়েক বছর আগে পর্যন্তও সেই ধারা বজায় রেখে পরিবারের সদস্যরা প্রতিমা গড়তেন। এখনও প্রাচীন মন্দিরে দেবীর পুজো হয়। রয়েছে আটচালা, নাটমন্দির। নাটমন্দির সহযোগে চণ্ডীমন্দির। একচালাতেই দীর্ঘদেহী প্রতিমা। আছেন জয়া-বিজয়া। চালার উপরে পৌরাণিক কাহিনি চিত্রায়িত। মনোরঞ্জন, স্বদেশরঞ্জন চৌধুরীরা জানালেন, পারিবারিক কালীমন্দিরের ঈশান কোণ থেকে মাটি এনে কণষষ্ঠীতে প্রতিমা গড়া শুরু হয়। ব্যবহার করা হয় কেলেঘাইয়ের জল।
ফাইল চিত্র।
দেবীর নাভিকূপে দেওয়া হয় সিঁদুর ও সুপারি। পুজোর ক’দিন পরম্পরা মেনে দেবীকে বিরাট পাথর ও পেতলের থালায় দিনে ষাট কেজি করে চালের নৈবেদ্য দেওয়া হয়। সঙ্গে শুধুমাত্র গুড়ের মিষ্টি। দেবীকে সাজানো হয় সোনা ও রুপোর গয়নায়। অষ্টমীতে এক কুইন্টল ঘি সহযোগে যজ্ঞাহুতির প্রথাও রয়েছে।
এই পুজো মিলনোৎসবও বটে। দেশবিদেশ থেকে হাজির হয়ে যান চৌধুরীবংশের ষাট শরিক। কেলেঘাই পেরিয়ে সবং, ময়না, পিংলা, নারায়ণগড় থেকে আসতে শুরু করেন দর্শনার্থীরা। চৌধুরীবাড়ির সুবিশাল চত্বরে কার্যত মেলা বসে যায়। নিশান পতাকা নিয়ে দলবদ্ধ ভাবে ঘটোত্তলন-সহ নানা কাজ করেন বিভিন্ন গ্রামের মানুষজন। মানত পূর্ণ হওয়ায় বংশপরম্পরায় পুজো দেন শয়ে শয়ে মানুষ। পরিবারের সদস্য বিভূতিভূষণ, পূর্ণেন্দু চৌধুরীরা বলেন, “জাতপাত নির্বিশেষে প্রজাদের এই পুজোয় যোগদানও একটা রীতি। দশমীতে প্রজারাই কাছি দিয়ে প্রতিমাকে টেনে নিয়ে গিয়ে কেলেঘাই নদীতে বিসর্জন দেন।” পুজোর সময় পরিবারের নিজস্ব ‘গোপালপুর চৌধুরী থিয়েটার’-এ গ্রামবাসীরাও গানবাজনা-অভিনয়ে যোগ দিতেন।
আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষকদের লেখায় উঠে এসেছে, স্বাধীনতা আন্দোলন ও ইংরেজদের অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা করার কাহিনি। চৌধুরীবাড়ির নানা উৎসবের ভিড়ের আড়ালে নানা বাহিনী গড়ে চলত লড়াই। বসত গুপ্ত আখড়া বা সমিতি। জমিদারি এলাকার বিপ্লবী ছাড়াও অন্য এলাকার বিপ্লবীদেরও আশ্রয় দেওয়া হত এই পরিবারে। এলাকায় লবণ আইন অমান্য ও ভারত ছাড়ো আন্দোলন সংগঠিত করায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন এই পরিবারেরই নগেন্দ্রনাথ চৌধুরী। কথিত আছে, এই পরিবারের আশ্রয়ে হওয়া একটি গুপ্ত সভায় আসার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত পুলিশের নজর এড়িয়ে আসতে পারেননি বিপ্লবী ক্ষুদিরাম।
কৌলিক রীতি মেনে পরম্পরা রক্ষা করতে আজও এই পুজোয় সমানাধিকার দিয়ে যাচ্ছেন চৌধুরীরা। যে কারণে এই পুজো এলাকার সর্বজনীন পুজোগুলোর মধ্যে জনপ্রিয়। প্রকৃত অর্থে অংশগ্রহণে, আবেগে, ভক্তিতে সর্বজনীন।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.