চার মাস পেরোল নতুন সরকার। ‘বিরোধী’ তৃণমূলের ‘শাসকে’ বদলে যাওয়াও ঠিক তত দিনেরই। ‘কাল’ অনন্ত। চার মাস নিতান্তই স্বল্প সময়। সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা মাপার পক্ষেও যেমন যথেষ্ট নয়, তেমনই নতুন অবতারে একটি রাজনৈতিক দলের দোষ-গুণ বিচারের পক্ষেও হয়তো পর্যাপ্ত নয়। কিন্তু কথায় বলে না, সকাল দেখেই বোঝা যায় দিনটা কেমন যাবে! সেই প্রবচন-রেখা ধরে বিচার করতে গিয়ে নতুন শাসকদলের অনেক শুভানুধ্যায়ীই কিন্তু খুব নিশ্চিন্ত বোধ করছেন না।
অথচ, ১৩ মে দিনটা খুব পিছনের কোনও তারিখ নয়। একটানা ৩৪ বছর ধরে সিপিএম তথা বামফ্রন্টের শাসনপর্বের ইতি টেনে সে দিনই জনতার রায়ে ক্ষমতায় এল তৃণমূল। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম-নেতাই পরবর্তী বাংলায় মানুষ খুব স্পষ্ট ভাবেই জানিয়ে দেন তাঁদের পছন্দ। তৃণমূলের বিপুল জয় জন্ম দেয় বাঁধ-ভাঙা উচ্ছ্বাস আর নতুন স্বপ্নের। পালাবদলে ‘খুশি’ তৃণমূল-সমর্থকরা এই চার মাসেই কিন্তু অনেকটাই হতোদ্যম হয়েছেন।
রাজ্যে ক্ষমতায় আসা নিয়ে তৃণমূল নেতৃত্বের যতটা ভরসা ছিল, পশ্চিম মেদিনীপুরে ‘ফলাফল’ নিয়ে কিন্তু তাঁরাও ততটা আত্মবিশ্বাসী ছিলেন না। কেশপুর-গড়বেতার জেলাতেও কিন্তু দিব্যি ছুটেছে তৃণমূলের বিজয়রথের ঘোড়া। আর সেই অভাবিত সাফল্যে দলের একাংশের ‘মাথা ঘুরে গেছে’ (বা দলে নতুন আসা লোকজনই ছড়ি ঘোরাচ্ছে) বলে এখনই অনুযোগ করতে শুরু করেছেন এত দিন মার খেয়েও দল করে আসা সাধারণ তৃণমূল সমর্থকরাও।
এই যেমন কেশপুরের আনন্দপুরের হেটলাপাড়ার পার্থ রায়। এলাকায় দলের নেতা-কর্মীদের একাংশের ‘জুলুম’ নিজেরা দলের সমর্থক হয়েও মানতে পারেননি পার্থবাবু বা তাঁর স্ত্রী পিউদেবী।প্রতিবাদ করায় দলের ‘মাথা ঘুরে যাওয়া’ নেতা-কর্মীরা পার্থবাবুদের ‘সামাজিক বয়কটে’র ফতোয়া জারি করেন বলে অভিযোগ। পৌরোহিত্য আর চা ফিরি করে কোনও রকমে সংসার চালানো পার্থবাবুরা আরও সমস্যায় পড়েন। উপরন্তু পার্থবাবুকে বাজারের মধ্যে কান ধরে ঘোরানো হয়। ‘অপমানিত’ পিউদেবী তার জেরেই বিষ-পানে আত্মঘাতী হন বলে অভিযোগ।
ভোটের ফলপ্রকাশের পর থেকে ‘জুলুম’-‘তোলাবাজি’র অগুনতি অভিযোগে ক্লান্ত দলের জেলা নেতৃত্বই এই চার মাসের মধ্যে গড়বেতার দুই নেতাকে দল থেকে সাসপেন্ড করতে বাধ্য হয়েছেন।
চন্দ্রকোনা-দাসপুরে দলের গোষ্ঠী-দ্বন্দ্ব রাস্তায় মারামারির পর্যায়ে নেমে এসেছে। স্কুল-ভোটে লড়াই হচ্ছে দলেরই একাধিক গোষ্ঠীর প্রার্থীদের মধ্যেই!
নয়াগ্রামে মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠী-পরিচালিত নার্সারি স্কুলের ‘দখল’ নিতে ব্লকের তৃণমূল নেতা-কর্মীরা শিক্ষিকাদের গায়ে হাত তুলতেও কসুর করেননি বলে অভিযোগ। নারায়ণগড়ে বিধানসভা-ভোটে দলের প্রার্থী তথা ব্লক সভাপতি সূর্য অট্টের বিরুদ্ধে দায়ের হয়েছে নাবালিকা পরিচারিকাকে যৌন নিপীড়নের মতো গুরুতর অভিযোগ। (নাবালিকাকে দিয়ে কাজ করানোর আইন-ভাঙা তো আছেই)।
কেশপুরে সিপিএমের ‘এক-দলীয় শাসন’ গিয়ে তৃণমূলের ‘একাধিপত্য’ কায়েম হয়েছে বলে স্থানীয় সূত্রেরই বক্তব্য। আর সেই শাসনতন্ত্রেও ‘সন্ত্রাস’ পূর্ণ মাত্রাতেই বিরাজমান বলে অভিযোগ। নতুন শাসকদের একাধিক গোষ্ঠীর বোমা-বন্দুকবাজিতে সেই ত্রস্তই কেশপুর।
অভিযোগের বিরাম নেই পিংলা, দাঁতন, খড়্গপুর গ্রামীণ কিংবা দুই পুরশহর মেদিনীপুর-খড়্গপুর থেকেও। দুই পুরবোর্ড পরিচালনা নিয়েই ‘ব্যর্থতা’র তকমা চেপে বসছে তৃণমূলের নামে। দলের কাউন্সিলরদের দ্বন্দ্বও খুব একটা গোপন নয়। আছে দুর্নীতিরও নালিশ। রেলশহরের যুবনেতার বিরুদ্ধে কি না এক মাফিয়া পর্যন্ত সাংবাদিক সম্মেলন করে তুলছে গুরুতর নানা অভিযোগ!
বিরোধী সিপিএমের তরফে তো সেই জুনের গোড়া থেকেই দাগা হচ্ছে ‘প্রতিহিংসার রাজনীতি’র তোপ। অস্ত্র ও হাড়গোড় উদ্ধারের প্রথম-পর্বে পূর্বতন শাসকদলের নানা ‘দুষ্কর্ম’ নিয়ে সন্দেহটা জনমনেও যতটা বিশ্বাসযোগ্য ঠেকছিল, ইদানীং জেলা পরিষদের সিপিএম সভাধিপতি অন্তরা ভট্টাচার্য কিংবা প্রবীণ বিধায়ক নাজমুল হককেও এহেন মামলায় জড়ানোর মতো ঘটনায় সেই ‘বিশ্বাস’ টলমল। পুরনো শাসকদলের কিছু ‘দুষ্কর্মে’র শাস্তি যেমন ন্যায়বিচারের স্বার্থেই হওয়া প্রয়োজন বলে সাধারণের ধারণা, তেমনই সেই পুরনো শাসকদের তোলা ‘প্রতিহিংসা’র তত্ত্বও কিছুটা হলেও সহানুভূতি কুড়োতে শুরু করেছে।
গরিব ভাগচাষির জমি কাড়া, বর্গা-উচ্ছেদ, সাধারণ বাম কর্মী-সমর্থকদের ঘরছাড়া করা, চাষাবাদ বন্ধে তাঁদের বাধ্য করা, এলাকায় থাকতে দেওয়ার শর্ত হিসাবে মোটা ‘জরিমানা’ আদায়, পঞ্চায়েত-পঞ্চায়েত সমিতির নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ইস্তফার জন্য হমকি দেওয়া, নির্বাচিত সংস্থায় অচলাবস্থা তৈরি করা, মারধর-হেনস্থা....এই চার মাসেই শাসকদলের বিরুদ্ধে অভিযোগের তালিকাটা রীতিমতো দীর্ঘ।
তৃণমূলের জেলা ও রাজ্য নেতৃত্ব প্রকারান্তরে কবুল করছেন সমস্যাটা। অভিযোগ খতিয়ে দেখতে কোথাও কোথাও কমিটি গড়ে ‘তদন্ত’ও নাকি হচ্ছে। গড়বেতা-চন্দ্রকোনার কোনও কোনও নেতার বিরুদ্ধে ‘ব্যবস্থা’ ঘোষণাও হয়েছে। তার পরেও প্রশ্ন থেকে যায়ভোটে বিপুল জয়ের সঙ্গেই জমতে থাকা বিপুলতর অভিযোগ সামলানোর সদিচ্ছা, সাংগঠনিক কাঠামো, নৈতিক জোর ও ‘কর্তৃত্ব’ (কম্যান্ড) নেতাদের আছে তো!
প্রশ্নের জবাবের সঙ্গেই কিন্তু জড়িয়ে নতুন শাসকদলের ভাবমূর্তি। বিপুল জয়ের সঙ্গে আসা বিপুল দায়িত্ব কী ভাবে সামলানো হয়তাই-ই কিন্তু ঠিক করে দেবে দল ও সরকারের ভবিষ্যত। |