|
|
|
|
নবাব নয়,আমার আড্ডাপ্রিয় ধুরন্ধর অধিনায়ক |
এরাপল্লি প্রসন্ন |
আমার প্রথম ক্যাপ্টেনের অসুস্থ হওয়ার খবরটা সংবাদপত্র পড়েই প্রথম জেনেছিলাম। দেখেই রিঙ্কুকে (শর্মিলা ঠাকুর) এসএমএস করি। তার পর থেকে গত কয়েক দিন এসএমএস-এ সারাক্ষণ খবর নিতাম, টাইগার কেমন আছে। আজ সকালে উঠে যখন জানলাম ওর শরীর আরও খারাপ হয়েছে, মনটা খারাপ হয়ে গেল। তখনও জানতাম না, মন ভেঙে দেওয়া দুঃসংবাদ অপেক্ষা করে আছে।
রোজকার মতো বৃহস্পতিবার সন্ধ্যাবেলাতেও এসএমএস করলাম টাইগারের শরীরের খোঁজ নিতে। তখনই শোকস্তব্ধ করে দিয়ে ও দিক থেকে জবাব এল, হি ইজ নো মোর! মনে হচ্ছিল, কথা বলার শক্তিই হারিয়ে ফেলেছি। কী ভাবে ব্যাখ্যা করব আমার প্রতিক্রিয়া? শোকস্তব্ধ? ঘোর যন্ত্রণাদায়ক? যা-ই লিখি না কেন, যথেষ্ট হবে না। চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছিল, এটা বলতে পারি।
কত রকম সব স্মৃতি! কী সব অভিজ্ঞতা! মনসুর আলি খান পটৌডি মানে তো আমার কাছে একটা অধ্যায় নয়, পুরো একটা বই। এক টিমে এক সঙ্গে তো অনেকেই খেলেছে। কিন্তু টাইগারের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল যে অল্প কয়েক জন ক্রিকেটারের, তাদের মধ্যে আমি ছিলাম। ওর পরিবারে একটা বিয়েতে যেমন প্রাক্তন সতীর্থদের অনেককেই দেখিনি। আমার কাছে কিন্তু কার্ড পৌঁছে গিয়েছিল। সঙ্গে ফোনও পেয়েছিলাম যে, তোমাকে কিন্তু আসতেই হবে। কোথায় নবাব? শুনে মনে হয়েছিল, এ তো বাড়ির বিয়েতে একদম সাধারণ গৃহস্থের মতো বন্ধুর কাছে আব্দার করছে, তুই না এলে কিন্তু বিয়েই হবে না!
বলছিলাম না, আমার জীবনে পটৌডি মানে গোটা একটা বই। আমার উত্থানটাই তো ওর হাতে। হায়দরাবাদে টেড ডেক্সটারের ইংল্যান্ড খেলছে প্রেসিডেন্ট্স ইলেভেন-এর সঙ্গে। স্কোয়াডে আমিও আছি। কিন্তু প্রথম একাদশে জায়গা হবে কি না জানি না। পটৌডির কথা তত দিনে সারা ভারত জেনে গিয়েছে। আর আমার এমনই কপাল যে, নেটে যখন বল করতে ডাকা হল তখন ব্যাট হাতে দাঁড়িয়ে কিনা স্বয়ং ক্যাপ্টেন। নবাবকে বল করতে হবে! এ তো বিরাট ভয়ের ব্যাপার। কয়েকটা বল করার পরেই দেখলাম টাইগার এগিয়ে আসছে। আমায় জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম কী? সেই প্রথম ক্যাপ্টেনের চোখে পড়া। তার পর নজরে থেকে গেলাম এক দশকের ওপর। হায়দরাবাদের ওই ম্যাচ চলাকালীনই কাছাকাছি আসতে শুরু করি আমরা। আড্ডার সেই মেজাজ থেকে প্রথমেই বুঝে গিয়েছিলাম, মনসুর আলি খান পটৌডি মোটেও ছবিতে দেখা বা রূপকথায় পড়া কোনও নাক উঁচু নবাব নয়। আমাদের আর পাঁচ জনের মতো রক্তমাংসের শরীর। যে আড্ডা দিতে ভালবাসে। বন্ধুত্ব করতে ভালবাসে। মজা করতে ভালবাসে। |
|
ইডেনে অধিনায়ক পটৌডি। ছবি: পাহাড়ী রায়চৌধুরী |
এর পর দেশের হয়ে যখন খেলা শুরু করলাম তখন আরও ভাল ভাবে ওকে জানতে পারলাম। ড্রেসিংরুমে মোটেও ওকে দেখে কেউ সিঁটিয়ে থাকত না। বরং লাঞ্চে বা টি-তে একটা ফুরফুরে পরিবেশ রাখা হত ক্যাপ্টেনের ইচ্ছাতেই। টাইগার নিজেই কত যে জোক্স বলত! সবথেকে বেশি ইয়ার্কি করত ফারুক ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে।
তত দিনে ওর স্টাইল নিয়েও আমরা বেশ প্রভাবিত। পটৌডিকে যারা তরুণ বয়সে দেখেছে, তারা একমত হবে যে, ও শুধু দেশের সেরা ক্যাপ্টেনই ছিল না, দেশের সবথেকে হ্যান্ডসাম ক্রিকেটারও বটে। আমরা বলতাম, ও হচ্ছে ভারতীয় বংশোদ্ভূত ইংরেজ। এমন মোহময় স্টাইল ছিল ওর!
আমাদের সময় এখনকার মতো সিরিয়াস টিম মিটিংয়ের ব্যাপার ছিল না। টিম মিটিংটা আমরা বেশি ব্যবহার করতাম চাপ হালকা করার জন্য। পটৌডি বিশ্বাস করত, নকশা বানানোটা ক্যাপ্টেনের কাজ। আর প্লেয়ারদের কাজ মাঠে নেমে সেই নকশাকে কাজে লাগানো। চার স্পিনারকে নিয়ে আলাদা বৈঠক বা গোপন ছক কষাকষির কোনও ব্যাপার ছিল না। সমস্ত প্ল্যান পটৌডির মাথায় ভরা থাকত। মাঠে যখন যে প্লেয়ার নামছে সেই অনুযায়ী ও এক-এক জন বোলারকে লেলিয়ে দিত। আর বলটা হাতে তুলে দেওয়ার সময় এক-দু’লাইনে যা মোক্ষম পরামর্শ দেওয়ার দিয়ে দিত। পটৌডি মুখে বেশি কথা বলত না। ওর চোখ কথা বলত। এটাই ছিল ওর স্টাইল। ক্লাইভ লয়েডকে নিয়ে আমায় যেমন বলে দিয়েছিল, ও কিন্তু তোমাকে মেরে আক্রমণ থেকে সরানোর ট্যাকটিক্স নেবে। তুমি ভয় পাবে না। খাঁচা শক্ত রাখো। ফ্লাইট করিয়ে যাও। কত বার এমন হয়েছে যে, মার খাচ্ছি। টাইগার এসে পিঠে হাত রেখেছে, যেমন ফ্লাইট করাচ্ছ করিয়ে যাও। লুপ দিয়ে যাও। মারলে মারবে। আই অ্যাম উইথ ইউ।
ক্যাপ্টেন হিসেবে টাইগারের এই জিনিসটা দেখার মতো ছিল। যখন যার ওপর আস্থা রাখত, শেষ পর্যন্ত যেত তাকে সমর্থন করার জন্য। চুয়াত্তরের ইডেন গার্ডেন্সে যেমন। সেই ঐতিহাসিক টেস্ট ম্যাচ। লয়েড আর কালীচরণ পিটিয়ে যাচ্ছে। ইডেন গর্জন করে যাচ্ছে, ক্যাপ্টেন কেন চন্দ্রশেখরকে দিয়ে বল করিয়ে যাচ্ছে! টাইগার কিন্তু অনড়। চন্দ্রকে দিয়ে বল করিয়ে গেল আর ওই স্ট্র্যাটেজিতেই আমরা টেস্ট জিতলাম। তার পরেই আমরা খেলতে গেলাম চেন্নাই। আমাকে নিয়ে তখন ঝড় বয়ে যাচ্ছে। প্রসন্নকে এখনই বসাও। ও কী করতে টিমে আছে? সমালোচনায় সমালোচনায় দগ্ধ টিমের অফস্পিনার এবং তার ক্যাপ্টেন। পটৌডিকে কিন্তু কেউ নড়াতে পারল না। আগাগোড়া আমাকে সমর্থন করে গেল। আর তার ফলও মিলল হাতেনাতে। চেন্নাইতে আমি নিলাম নয় উইকেট। |
টাইগারের মগজাস্ত্র |
১৯৬৪, মুম্বই, প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া |
দ্বিতীয় ইনিংসে এক সময় ববি সিম্পসনের অস্ট্রেলিয়া ছিল ২৪৬-৩।
অভিষেক টেস্টে নামা চন্দ্রশেখরকে এক দিকে এবং বাপু নাদকার্নিকে
অন্য দিকে এনে চমক দেন। অস্ট্রেলিয়া ২৭৪ রানে শেষ।
ভারত দু’উইকেটে জেতে। পটৌডি করেন ৮৬ এবং ৫৩।
|
১৯৬৮, নিউজিল্যান্ড সফর |
বিদেশের মাঠে প্রথম টেস্ট সিরিজ জয়ে তিন স্পিনারকে কাজে লাগানো।
বিদেশে স্পিন দিয়ে যে বাজিমাত হয়, প্রথম দেখান।
|
১৯৭৪, কলকাতা, প্রতিপক্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ |
ইডেনে জিততে ৩১০ তাড়া করে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে প্রায় জেতার
জায়গায় পৌঁছে দেন লয়েড-কালীচরণ। দর্শক বিদ্রুপ
অগ্রাহ্য করে চন্দ্রশেখরকে দিয়ে বল করিয়ে অবিশ্বাস্য জয়।
|
ব্যাটিং |
অধিনায়ক |
টেস্ট ৪৬,
ইনিংস ৮৩,
রান ২৭৯৩,
গড় ৩৪.৯১,
সর্বোচ্চ ২০৩ ন.আ.,
সেঞ্চুরি ৬ |
টেস্ট ৪০,
জয় ৯,
হার ১৯, ড্র ১২ |
|
|
|
মাত্র একুশ বছরে ক্যাপ্টেন হয়েও শুরু থেকে খুব পরিষ্কার নীতি নিয়ে এসেছিল টাইগার আমি আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলব। ওকে আমি দেশের সর্বকালের সেরা ক্যাপ্টেন বলব এই কারণেই। ওর পরে সৌরভকে আক্রমণাত্মক ক্যাপ্টেন্সি করতে দেখেছি। কিন্তু আমার মনে হয়, টাইগার আরও অনেক আগ্রাসী ছিল। এবং অবসরের এত দিন পরেও ওর চিন্তাভাবনা একই রকম ছিল। এই তো বছর দু’য়েক আগের কথা। দিল্লিতে গিয়েছি পরিবার নিয়ে। আমি আর বিষেণ (বেদি) ঠিক করলাম টাইগারের বাড়ি ঘুরে আসব। দু’জনে সপরিবার গেলাম ডিনার করতে। ক্রিকেট-আড্ডায় বারবার বলল, এখনকার স্পিনাররা তো মেরেকেটে দশ ওভার আক্রমণাত্মক বোলিং করে। আর ভাবো, তোমাদের দিয়ে আমি সারা দিন ধরে অ্যাটাক করাতাম।
চার স্পিনার নিয়ে ওর বক্তব্য ছিল, দিনে যদি একশো ওভার বোলিং হয় তা হলে ম্যাচ জিততে গেলে বোলারদের দিয়ে অন্তত আশি ওভার আক্রমণ করাতে হবে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ যদি চারটে পেসার দিয়ে আশি ওভার আক্রমণ করিয়ে যেতে পারে তা হলে আমি চারটে স্পিনার দিয়ে কেন করাতে পারব না? আর একটা কথা খুব বলত যে, প্রতিপক্ষের স্কোরটাকে ধরাছোঁয়ার মধ্যে রাখতে না পারলে ব্যাটিং বিশ্বসেরা হলেও টেনশনে পড়ে যাবে। প্রতিপক্ষের স্কোরটা যদি ২৫০-৩০০ রানের মধ্যে বেঁধে রাখা যায়, তা হলে নিজেদের ব্যাটসম্যানরাও অনেক ভাল লড়াই করবে।
আমাদের টিমকে এই ইংল্যান্ড সফরে বিপর্যস্ত হতে দেখে বারবার মনে হচ্ছিল, আহা! ধোনিদের যদি এক বার টাইগারের ক্লাসে বসানো যেত! |
|
|
|
|
|