আশির দশক। হাওড়া স্টেশন। রাজধানীর কামরা।
আমাদের স্পোর্টসওয়ার্ল্ডের সম্পাদক টাইগার দিল্লি যাচ্ছেন। ট্রেন ছাড়ার আগে স্পোর্টসওয়ার্ল্ডের পুরো এডিটোরিয়াল টিমের মিটিং চলছিল রাজধানীর কামরায়। মিটিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে চলছে নানা রকম গল্প। পর্দা যেহেতু টাঙানো, আড্ডা মারতে মারতে আমরা বুঝতেই পারিনি ট্রেন কখন চলতে শুরু করেছে। তত ক্ষণে ট্রেনের টিটি এসে আতঙ্কিত হয়ে আমাদের ছ’জনকে নামতে বলছেন। আইডিয়াল ক্যাপ্টেনের যেমন যে কোনও পরিস্থিতিতেই মাথা ঠান্ডা থাকে, টাইগারও দেখলাম তেমনই শান্ত ভাবে আস্তে করে বললেন, “এর থেকে তো ভাল হত যদি তোমরা আমার সঙ্গে দিল্লিই চলে আসতে।” সে দিন দৌড়ে আমরা ছ’জন লাফিয়ে নেমে পড়েছিলাম চলন্ত ট্রেন থেকে। আজকে যখন টাইগার নেই তখন বিশেষ করে মনে পড়ছে সেই দিনটার কথা। সত্যিই যদি আমরা ছ’জন মিলে দিল্লি চলে যেতাম, টাইগারের মুখ থেকে আরও কত গল্পই না শুনতে পেতাম রাজধানীর সেই ট্রেন জার্নিতে।
মেলবোর্নের ভোররাতে লিখতে বসে নীল রঙের আভিজাত্য মোড়া আমাদের সম্পাদক সম্পর্কে নানা অজানা তথ্য না লিখে পারছি না। টাইগারের আসলে একটা দুর্বলতা ছিল। না, সেটা ওঁর কভার ড্রাইভ নয়। সেটা ওঁর ফিল্ডিং নয়। সেটা ছিল প্লেনের চড়ার ভয়। ভারতবর্ষে যখনই থাকতেন সর্বদাই এয়ারপোর্টের লাউঞ্জের থেকে রেলওয়ে প্ল্যাটফর্ম ছিল টাইগারের অনেক প্রিয় জায়গা। হ্যাঁ, বিদেশের ট্যুরে প্লেনে যেতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু সেটা একেবারে উপায় না থাকায়।
স্পোর্টসওয়ার্ল্ড ছেড়ে দিয়েছি অনেক বছর। কিন্তু একটা প্রশ্ন আজও আমাকে তাড়া করে বেড়ায় লোকজন আজও জিজ্ঞেস করেন, স্পোর্টসওয়ার্ল্ডের সম্পাদকীয় কি টাইগার সত্যি নিজে লিখতেন? এর একটাই উত্তর হয়। ওই সম্পাদকীয়র প্রত্যেকটি শব্দ লিখতেন টাইগার। হয়তো প্রত্যেক সংখ্যায় লিখতে পারতেন না, কিন্তু যখনই লিখতেন তখনই চাঁচাছোলা ভাবে কলম ধরতেন। এবং তাঁর সে সব লেখা কাঁটাছেঁড়া করার কোনও দিনই দরকার পড়েনি।
১৯৭২ সালে টনি লুইসের ইংল্যান্ড টিম যখন ভারতে এসেছিল, তখন টিম থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল টাইগারকে। জীবনে ওই এক বারই বাদ যান তিনি। আনন্দবাজার পত্রিকার প্রধান সম্পাদক অভীক সরকারের কাছে শুনেছিলাম, তিনি তখন সরাসরি চিঠি লিখে জানতে চেয়েছিলেন যে টাইগার সিরিজ নিয়ে হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ডের জন্য কলম ধরবেন কি না? পরের দিনই টাইগারের কাছ থেকে সম্মতিসূচক টেলিগ্রাম আসে। হ্যাঁ, তিনি রাজি আছেন।
প্রথম লেখাতেই ছক্কা। শুনেছিলাম টাইগারের লেখাগুলো শুরু থেকেই এমন আলোড়ন ফেলেছিল যে সত্যজিৎ রায় অবধি অভীকবাবুকে ফোন করেছিলেন, “আপনার নবাবের লেখা কিন্তু খুব ভাল লাগছে।” |
আসলে প্রথম লেখাতেই টাইগার বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর কলমের জোর। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিলেই বুঝতে পারবেন। একনাথ সোলকারকে নিয়ে লিখলেন, “সোলকার ইজ স্ট্রং অন দ্য লেগ সাইড বাট হ্যাজ দ্য ক্লাসিক উইকনেস অফ মোস্ট লেফট্ হ্যান্ডারস টু আ বল দ্যাট ইজ বোলড ওভার দ্য উইকেট বাই আ রাইটহ্যান্ড সিমার--- আ বল হুইচ, ডিউ টু দ্য অ্যাঙ্গেল অফ ডেলিভারি, ন্যাচারালি মুভস অ্যাওয়ে ফ্রম দ্য ব্যাট আফটার পিচিং। দ্য এলবিডবলিউ রুল ফোর্সেস ওয়ান টু প্লে দিস টাইপ অফ ডেলিভারি, ইনকেস ইট ডিভিয়েটস ইন অ্যান্ড ক্যাচেস ওয়ান ইন ফ্রন্ট, স্ট্রোকলেস।” কী অনবদ্য ছিল টাইগারের শব্দচয়ন! স্পোর্টসওয়ার্ল্ডে তাঁর প্রথম সম্পাদকীয় থেকে আজও লোকে গড়গড় করে লাইন বলে দেয়।
স্পোর্টসওয়ার্ল্ডে সম্পাদক হিসেবে তখনও যোগ দেননি। শুনেছি টাইগার তখন অভীকবাবুর সঙ্গে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে লেখক জোগাড়ের জন্য ঘুরতেন। এক দিন পৌঁছে গিয়েছিলেন লন্ডনে হ্যারডসে রিচি বেনোর পন্ড স্ট্রিটের বাড়িতে। ওঁরা দু’জনেই চাইছিলেন রিচি বেনো স্পোর্টসওয়ার্ল্ডের জন্য লিখুন। কথাবার্তা চূড়ান্ত হয়ে যাওয়ার পর টাইগার রিচিকে জিজ্ঞেস করলেন, তিনি পারিশ্রমিক কত নেবেন? সঙ্গে সঙ্গে রিচি জানান, এটা পটৌডির প্রথম কাজ, তাই তিনি কোনও পারিশ্রমিকই নেবেন না। বহু পীড়াপীড়ির পর রিচি বেনো বললেন, যদি দিতেই হয় তাঁকে যেন একটি বিশেষ ব্র্যান্ডের ওয়াইন দেওয়া হয়। টাইগার নাকি তখন অভীকবাবুকে বলেছিলেন, “ইটস ইওর কল। ইউ আর দ্য বস।” বলাই বাহুল্য ক’দিনের মধ্যে রিচি বেনোর কাছে সেই ওয়াইন কেস পৌঁছে গিয়েছিল।
আরও একটা গল্প শুনেছিলাম। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ এবং টাইগার নাকি একই সময়ে অক্সফোর্ডে ছিলেন। টাইগারকে বছরখানেক আগে জিজ্ঞেস করা হয়, সেই সময় মনমোহন সিংহের সঙ্গে তাঁর দেখা হত কি না? স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে টাইগার বলেছিলেন, “আলাপ হবে কী করে? ও তো কোনও দিন মদ খেতেই আসত না।”
এমনই ছিলেন টাইগার।
যাঁরা ওঁকে চিনতেন না তাঁরা প্রায়ই মনে করতেন টাইগার সহজে সবার সঙ্গে মিশতে পারেন না। কিন্তু সত্যিটা হল, টাইগার ছিলেন অত্যন্ত লাজুক প্রকৃতির। হি ওয়াজ আ প্রাইভেট ম্যান। কোনও অপরিচিত অজানা লোক দেখা করতে এলেও তিনি কোনও দিন ফিরিয়ে দেননি। তবে এই সব দেখা-সাক্ষাৎ করার চেয়ে দুপুরবেলা একদান ব্রিজ খেলা টাইগারের কাছে ছিল বেশি পছন্দের। আমার মনে আছে যখন আমার বাবা মারা যায় টাইগার নিজে হাতে একটি চিঠি লিখেছিলেন আমায়। আজকে এত দিন পরেও সেই চিঠিটি আমার কাছে থেকে গিয়েছে।
টাইগার কিন্তু প্র্যাকটিক্যাল জোকসেরও নবাব ছিলেন। কলকাতায় একটি টেস্ট ম্যাচ (যেখানে অ্যান্ডি রবার্টসের বল লেগে ওঁর থুতনি ফেটেছিল) চলাকালীন টিম বাস ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের পাশ থেকে ইডেনের দিকে যাচ্ছিল। হঠাৎ করে পাশে বসা এক টিমমেটকে তিনি বলেন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল আসলে ওঁদের পরিবারের এক রাজপ্রাসাদ। টাইগার হয়তো ভেবেছিলেন ওঁর সতীর্থ ধরে ফেলবেন অপূর্ব এই মিথ্যাভাষণ। কিন্তু আদতে তা হয়নি। পাশে বসা সতীর্থ সত্যি ভেবে বসেন যে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল পটৌডি পরিবারের সম্পত্তি। তা দেখে টাইগার আরও এক ধাপ এগিয়ে যান। সেই সতীর্থকে তিনি সে দিন সন্ধেবেলা রাজপরিবারের সঙ্গে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে ডিনারের নেমতন্ন করেন। পরে শুনেছিলাম সেই সতীর্থ নাকি স্যুট-টাই পরে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনে পৌঁছে যান। আর লোকজনকে জিজ্ঞেস করা শুরু করেন, ‘নবাব সাহেব কোথায় গেলেন?’ এমনই ছিল টাইগারের রসবোধ।
সেই সময়ে স্পোর্টসওয়ার্ল্ড টিমের সঙ্গে ডালহৌসি ইনস্টিটিউটের লনে প্রায়ই আমাদের আড্ডা বসত। এক দিন এ রকম আড্ডা মারতে মারতেই দেখলাম কয়েকটি ছেলে উইকেট পুঁতে ক্রিকেট ম্যাচের তোড়জোড় করছে। একে একে আমরা সবাই যোগ দিলাম। হ্যাঁ টাইগারও। তবে টাইগার সে দিন ব্যাট করেননি। কিন্তু সেই দিনও ফিল্ডিংয়ে তাঁর পাশ দিয়ে একটা বলও বেরোয়নি। আমার এক সতীর্থ সে দিন উইকেট কিপিং করছিল। আজ প্রায় কুড়ি বছর পরেও সেই ম্যাচের প্রসঙ্গ উঠলেই সেই বন্ধু উইকেটকিপারটি বলে ওঠে, ওর হাতে পটৌডির একটা রিটার্ন থ্রো আজও লেগে আছে। এতটাই তীব্রতা ছিল সেই থ্রো-এ।
দু’দিন আগেই আমি একটি এসএমএস পাই স্পোর্টসওয়ার্ল্ডের এক প্রাক্তন সহকর্মীর কাছ থেকে। তিনিই আমাকে জানান টাইগারের শরীর খুব খারাপ। টাইগারের পুরনো বাড়ির ফোন নম্বরটি আজও আমার মুখস্থ। কিন্তু ওঁর মোবাইল নম্বর কী ছিল সেটা আমি জানতাম না। সত্যি কথা বলতে কি, জানারও চেষ্টা করিনি। আমার কখনও মনেই হয়নি টাইগারের কোনও ক্ষতি হতে পারে। শুধু মনে হয়েছিল টাইগার হয়তো হাসপাতালে শুয়ে শুয়ে রেগে যাচ্ছেন ওঁর প্রিয় ব্রিজ খেলতে পারছেন না বলে।
আজকে রাত আড়াইটের সময় এই লেখা লিখতে গিয়ে মনে হচ্ছে টাইগারকে সেই ফোনটা করা উচিত ছিল। আই অ্যাম সরি টাইগার।
আজকে ফিরে তাকালে মনে হয়, উই ওয়্যার অ্যান অড পেয়ার। আমি মধ্যবিত্ত, টাইগার রাজসিক অভিজাত। আমি ক্রিকেট খেলেছি স্কুলে, টাইগার ভারতের টেস্ট ক্যাপ্টেন। আমি খ্রিস্টান, টাইগার মুসলিম। কিন্তু আমরা দু’জনেই তো একই দেবতাকে পুজো করতাম। যে দেবতার নাম ক্রিকেট। আর লড়তাম একই ম্যাগাজিনের জন্য। আমি ছিলাম কার্যত সহ-সম্পাদক। আমার বসই তো এই পৃথিবী থেকে চলে গেলেন।
উইল মিস ইউ টাইগার। |