|
|
|
|
ক্রিকেট স্বর্গে ঘুমোতে গেলেন পটৌডি |
গৌতম ভট্টাচার্য • কলকাতা |
অ্যাই জয় একটা সিগারেট দে তো!
টাইগার পটৌডির কথা শুনে জয়সিংহ হাসিমুখে গোল্ডফ্লেকের প্যাকেটটা দ্রুত বার করলেন। দেখা হলেই সিগারেট এক্সচেঞ্জ, এটা তো দুই বন্ধুর বহু দিনের অভ্যেস। আড্ডার মেজাজে তখন ওঁরা প্রাক্তন নেতাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে। জয়সিংহ, সারদেশাই, হনুমন্ত সিংহ, সোলকাররা। এত দিন বাদে দেখা, কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। হনুমন্ত বললেন, নিশ্চয়ই টায়ার্ড। পটৌডি বললেন, নট রিয়েলি। একটু ঘুমোলে ঠিক হয়ে যাবে। সারদেশাইয়ের দিকে তাকালেন। বললেন, তোর ক্যাচিং নিশ্চয়ই একই রকম খারাপ আছে! যা-ই হোক, রাত্তিরে ব্ল্যাক লেবেলটার ব্যবস্থা করিস।
এ বার চোখ পড়ল সোলকারের দিকে। যিনি হাতে একটা মোটা ফাইল নিয়ে দাঁড়িয়ে। গাদাগুচ্ছের সিডি আর পেপার কাটিং সেখানে। উচ্ছ্বসিত হয়ে সোলকার এগিয়ে এলেন তাঁর ভালবাসার নবাবের দিকে। মিস্টার পটৌডি, অনেক দিন বাদে দেখা হল। এই দেখুন, কত কাগজ আর
চ্যানেল আমাদের লোকে আপনার আগমন কভার করেছে। পটৌডি এক ঝলক তাকালেন। মুখে বিরক্ত ভাব।
বললেন, এত কী করেছে? এত প্রয়োজন ছিল না। একটা লেখাই তো যথেষ্ট। সবাইকে হাত-টাত নেড়ে এ বার নিজে ঘুমোতে চলে গেলেন।
ক্রিকেট স্বর্গে মনসুর আলি খান পটৌডি এবং তাঁর টিম। প্রথম দেখা হতে প্রিয় স্যাঙ্গাতদের সঙ্গে সংলাপের আদানপ্রদান কী হতে পারে, তাঁর সমসাময়িক এক ক্রিকেটারের সঙ্গে ঝালিয়ে নিয়েই ওপরের প্যারাগ্রাফটা লিখলাম। নবাবের টিমে জীবিত বাকিদের সঙ্গে কথা বললেও মনে হয়, উদ্বোধনী দৃশ্যের জন্য অবিকল এই সংলাপ বেরিয়ে আসত। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নয়াদিল্লির গঙ্গারাম হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা পটৌডি পরিচিত সবার জন্যই ছিলেন মোটামুটি একই রকম অভিজ্ঞতা। মিতবাক, যথাসম্ভব আবেগহীন, কথাবার্তায় ব্রিটিশ আন্ডারস্টেটমেন্টকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া, পরিহাসপ্রিয়, ঝুঁকিপূর্ণ অথচ বাহুল্যহীন।
ক্রিকেট অধিনায়কত্ব পেয়েছিলেন ২১ বছর ৭৭ দিনে। মাত্র সাত বছর আগেও সেটা ছিল কনিষ্ঠতম অধিনায়কের বিশ্বরেকর্ড। আর চলে গেলেন ৭০ বছর ২৬০ দিনে। মৃত্যুর বছর খানেক আগে তাঁর বসন্ত বিহারের অসম্ভব সাজানো-গোছানো বাড়িতে বসে একটা অ-পটৌডিচিত, অকপট সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “আমার অর্ধেক টিমটাই তো ওপরে চলে গিয়েছে। বেচারি জয়, এত যন্ত্রণার মধ্যেও শেষ দিনগুলো কাটাল, যা হয়তো ওর প্রাপ্য ছিল না। মনে হচ্ছে, আমার নিয়তি আমাকেও ভবিতব্যের জন্য তৈরি করে দিচ্ছে। যেতে হবেই, সবাই যাচ্ছে। শুধু একটাই প্রার্থনা, ঈশ্বর, যাওয়ার বেলায় যেন কষ্ট না পেয়ে যেতে হয়।” ঈশ্বর যে সেই নীরব প্রার্থনা শুনেছেন, এমন নয়। একটা চোখ যেমন ক্রিকেট কেরিয়ারের শুরুতেই অকেজো হয়ে গিয়েছিল। একটা ফুসফুসও আর কাজ করছিল না বেশ কিছু দিন। এক চোখে অ্যান্ডি রবার্টস, গ্রাহাম ম্যাকেঞ্জিদের খেলতেন। দু’টো বল দেখতেন। খেলতেন যে বলটা ভেতরে আসছে, সেটা। অন্যটা ইগনোর করতেন। একটা ফুসফুস দিয়ে ম্যানেজ করা হল না। সম্প্রতি ডাক্তারি পরামর্শ অগ্রাহ্য করে ‘পটৌডি ট্রফি’ অ্যান্ড্রু স্ট্রসের হাতে তুলে দিতে লন্ডন যাওয়াটা আরও কাল হল তাঁর। অসুস্থতা বেড়ে গিয়েছিল। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন পটৌডির নবম ও শেষ নবাব চলে গেলেন ডানেডিনে নিজের অধিনায়কত্বে বিদেশে ভারতের প্রথম জয় সম্পন্ন করার ঠিক তেতাল্লিশ বছর বাদে। আর একটা ব্যক্তিগত রহস্য অনাবিষ্কৃতই রেখে দিলেন। দীর্ঘ ছাব্বিশ বছরের পরিচিতিতে ওই একটা দিন এমন আবেগাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন কী ভাবে? জয়সিংহর মৃত্যু ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল তাঁর এত বছরের মিতবাক, অভিজাত ব্যক্তিত্ব? জানার উপায় থাকল না আর। |
মনসুর আলি খান পটৌডি |
জন্ম: ৫ জানুয়ারি ১৯৪১ মৃত্যু: ২২ সেপ্টেম্বর ২০১১ |
• ১৯৬১: ২০ বছর বয়সে গাড়ি দুর্ঘটনায় ডান চোখ নষ্ট
• ১৩ ডিসেম্বর ১৯৬১: নয়াদিল্লিতে টেস্ট অভিষেক ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে
• ২৩ মার্চ ১৯৬২: নরি কন্ট্রাক্টর চোট পাওয়ায় ২১ বছর ৭৭ দিন বয়সে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে অধিনায়ক
• ফেব্রুয়ারি ১৯৬৪: নিজের সেরা স্কোর, ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে অপরাজিত ২০৩
• ১৯৬৪: অর্জুন পুরস্কার
• ১৯৬৭: পদ্মশ্রী
• ফেব্রুয়ারি-মার্চ ১৯৬৮: বিদেশে প্রথম সিরিজ জয়, নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে।
• ২৭ ডিসেম্বর ১৯৬৯: শর্মিলা ঠাকুরের সঙ্গে বিয়ে
• ১৯৭১: গুরগাঁও কেন্দ্রে হরিয়ানা বিশাল পার্টির হয়ে লোকসভা নির্বাচনে লড়াই
• ডিসেম্বর ১৯৭২: ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে সিরিজের প্রথম দুই টেস্টে দল থেকে বাদ
• ২৩ জানুয়ারি ১৯৭৫: মুম্বইয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে শেষ টেস্ট
• ১৯৯৩-১৯৯৬: আইসিসি ম্যাচ রেফারি
• অক্টোবর ২০০২: ভারতীয় ক্রিকেটার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রথম প্রেসিডেন্ট
• জুন ২০০৫: কৃষ্ণসার হরিণ মারার অভিযোগে গ্রেফতার
• ২০০৮: আইপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের সদস্য
• অক্টোবর ২০১০: গভর্নিং কাউন্সিলের সদস্যপদ থেকে ইস্তফা
• এপ্রিল ২০১১: বোর্ডের বিরুদ্ধে মামলা বম্বে হাইকোর্টে |
|
|
|
মাসখানেক আগে টাইগার পটৌডির খুব ঘনিষ্ঠ এক জন সচিন তেন্ডুলকর সম্পর্কে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় বলেছিলেন, একটা লাইন বলতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু আমার মুখ দিয়ে না বলাই ভাল। কথাটা হল, টাইগারের যদি দু’টো চোখ থাকত, তা হলে আজকের দিনে সচিনকে নিয়ে হয়তো এই মাতামাতি হত না। পটৌডি ব্যাকরণসম্মত ছিলেন না কোনও দিনই। সর্বকালের সেরা মরাঠিদের মতো। গাওস্কর যদি স্বয়ং ব্যাটিং ব্যাকরণ হন, সচিন যদি হন ব্যাটিং প্রতিভা, পটৌডি তা হলে ছিলেন ব্যাটিং উচ্ছ্বাসের রাজপুত্র। সাসেক্সে আজও লোকগাথার মতো ঘোরে, কী ভাবে ব্যাট করার সময় বাজি ধরে মাঠের পাশে পার্ক করা গাড়িতে বল ফেলতেন পটৌডি। ওই সময় প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তাঁর গড় যাচ্ছিল ৮০। শেষ করলেন টেস্ট ক্রিকেটে ৬টা সেঞ্চুরি-সহ মাত্র ৩৪ গড় নিয়ে। সেই সময় টেস্ট ক্রিকেটের ব্যাটিং তাঁর সর্বোচ্চ প্রতিবন্ধকতার সামনে পড়ত। আনকভারড উইকেট। প্রতিরক্ষার সরঞ্জাম না থাকা মাথা। সবুজ পিচ। ভয়ঙ্কর ফাস্ট বোলার। একটা চোখ চলে যাওয়া তাঁর ক্রিকেটের শতকরা ৫০ থেকে ৬০ ভাগ কেড়ে নিয়েছিল। কনট্যাক্ট লেন্স লাগিয়ে শেষ চেষ্টা করেছিলেন। তাতে সমস্যা বাড়ল। আরও বেশি বল দেখা শুরু করলেন। তখন লেন্স খুলে টুপিটাকে সাইড করে ঢেকে দিতেন একটাকে। যাতে ধেয়ে আসা বলের সংখ্যা দুই-ই থাকে। আজকের দিনে অবিশ্বাস্য মনে হবে। অথচ সত্যি।
ঐতিহাসিক ভাবে অবশ্য ভারতীয় ক্রিকেট ব্যাটসম্যান নয়, অধিনায়ক পটৌডিকে মনে রাখবে। অক্সফোর্ডে তাঁর এবং ইমরান খানের কলেজের মধ্যে দূরত্ব এক কিলোমিটারেরও কম। পটৌডি মজা করে বলতেন, ইমরান কাছাকাছি থাকা মানে আতঙ্কিত ব্যাটসম্যানের চেয়ে হিংসুটে স্বামীর সংখ্যা বেশি। স্পোর্টস ওয়ার্ল্ডে এক বার লিখেছিলেন, ‘বোর্ডের কাছে আমার বেনিফিট ম্যাচ চাই না। ইমরানকে মহিলাদের মধ্যে নিলাম করো। যেটা পাওয়া যাবে সেটাই আমার বেনিফিট পার্স!’ আনন্দবাজারের জন্য ইমরানের কাছে প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়েছিলাম। বৃহস্পতিবার রাতে শোকস্তব্ধ ইমরানের গলা টিভিতে শুনে সুপারইম্পোজ করে এল সেই পুরনো প্রতিক্রিয়া। “টাইগার, আমিও মুখ খুলতে পারি। অক্সফোর্ডের পুরনো গল্প আমিও শুনেছি। আমার মনে হয়, এখনও ওকে অক্সফোর্ডে নিলাম করলে আমি খারাপ টাকা পাব না।” পটৌডি খেলা ছাড়ার চার বছর আগে ইমরানের আন্তর্জাতিক আবির্ভাব। এক কাউন্টির হয়ে খেললেও একে অপরের বিরুদ্ধে খেলেননি। ড্রেসিংরুমও শেয়ার করেননি। কিন্তু কোথাও যেন চিন্তাভাবনা এবং যুগোত্তীর্ণ মনোভাবে তাঁরা একই বংশের সন্তান। উপমহাদেশীয় ক্রিকেটে দু’জনেই আমদানি করেছিলেন বন্য সাহস। ইমরান যেমন অখ্যাতদের তুলে আনতেন দুমদাম। পটৌডি তেমনই বেঙ্গালুরুর একটা ক্লাব ম্যাচ থেকে তুলে এনেছিলেন গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথকে। নির্বাচকদের সঙ্গে প্রচুর ঝামেলা হয়েছিল। অনেকে মনে করেন, ১৯৭১-এ মার্চেন্টের কাস্টিং ভোটটা তাঁর বিরুদ্ধে যাওয়ার এটাও অন্যতম কারণ। কিন্তু তাতে পরোয়াই করেননি। ভারতীয় ক্রিকেটে ফিল্ডিং সচেতনতার পথিকৃত পটৌডি। নিজে কভারে দুর্দান্ত ফিল্ডিং করতেন। গোটা দলকেও চাগিয়েছিলেন। মাঠে জুয়া খেলেছেন চন্দ্রশেখরকে নিয়ে এবং জিতেছেন। রাজ সিংহ মৃত্যুর আগেও বলেছেন, তাঁর দেখা সেরা ভারতীয় অধিনায়কের নাম পটৌডি। অধিনায়কত্বে আধুনিক মনন আমদানি, এটা যদি তাঁর সবচেয়ে চোখ ঝলসানো কৃতিত্ব হয়, তা হলে একই রকম গুরুত্বের হল, ড্রেসিংরুমে হীনমন্যতাবোধের অবসান ঘটানো। ক্রিকেটের মতো মানসিক খেলায় এটা নিজের দেশের ক্রিকেট-তহবিলে দশ হাজার রান দান করার সমান। তুল্যমূল্য বিচারে দুই অধিনায়কের মধ্যে ইমরান অনেক বেশি সফল। তিনি নিজে-সহ তাঁর পাকিস্তান দলে এক জোড়া বিশ্বত্রাস ফাস্ট বোলার ছিল। পটৌডির টিমে এক দিকে পেস বোলিং ওপেন করেছেন গাওস্কর। কখনও নতুন বলেই বেদী। বিচিত্র কী যে, একবার আনন্দবাজারের সাক্ষাৎকারে বলে ফেলেছিলেন, “হায়, আমি যদি একটা কপিল দেবও পেতাম!”
তাই পটৌডিকে বোঝাতে পরিসংখ্যান দুই ব্যাটারির টর্চের আলো হতে পারে। কিছুতেই ঝাড়বাতি নয়। মানুষটা প্রকৃত অর্থেই ছিলেন অপেশাদার। তথ্য, রেকর্ডের খুঁটিনাটি, রুটিন কাজ এ সবের প্রতি কোনও আসক্তি ছিল না। প্রচুর লোভনীয় অফার সত্ত্বেও নিয়মিত টিভি কমেন্ট্রি করতে রাজি হননি। তাঁকে ফোন করার সময় পরিচিত সাংবাদিকদের মোটামুটি জানাই ছিল, বেলা বারোটার আগে কখনও নয়। ক্রিকেট অত্যন্ত উত্তেজক না হলে দেখতেই চাইতেন না। রাজসিক এমন একটা আলস্য ছিল যে, একেক সময় মনে হত, এই লোকটাই বিদ্যুৎ গতিতে কভারে ফিল্ডিং করত? নাকি সেটা অন্য কেউ? এটা পটৌডি টু?
শারজায় ’৮৬-র অস্ট্রেলেশিয়া কাপ। সব টিম এবং বিশেষজ্ঞরা যেখানে উঠেছেন, সেই শারজা কন্টিনেন্টাল হোটেলে আমার রুমমেট টেলিগ্রাফের তখনকার ক্রীড়াসম্পাদক অশোক কামাথ। পটৌডি দু’টো ফ্লোর ওপরে। আমাদের ঘরে মাঝে মাঝে আসতেন। স্পোর্টস ওয়ার্ল্ডে নিজের সম্পাদকীয় দেওয়া আর সিগারেট খাওয়ার জন্য। বাইপাসের পর তখন তাঁর সিগারেট খাওয়া বারণ। ওপরের ফ্লোরে যে হেতু স্ত্রী শর্মিলা আছেন, আমাদের ঘরটা ছিল ওঁর গোপন স্মোকিং জোন। ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের আগের রাত্তিরে অশোক গিয়েছে দুবাইয়ের ডিস্কোয়। শারজায় মদ্যপান ঘোরতর নিষিদ্ধ। আজও নিষিদ্ধ। কিন্তু না খেলে ও নাকি ইন্ডিয়া-পাকিস্তান ম্যাচ লিখতে পারবে না! আমাদের চুক্তি হল, রাত্তির এগারোটার মধ্যে ও ফিরলে আমি দরজা খুলব। নইলে অন্য কারও ঘরে থেকে যাবে। তখন পাঁচতারা হোটেলেও ম্যাগনেটিক চাবির চল ছিল না। পেতলের চাবি। যে পরে আসবে, তার জন্য রুমমেটকে উঠে দরজা খুলতেই হবে। বারোটা অবধি অপেক্ষা করে করে ঘুমিয়ে পড়েছি। পর দিন খেলা শুরু সকাল ন’টায়। মাঠ ঢুকতে হবে তারও একঘণ্টা আগে। রাত দেড়টা নাগাদ দরজায় প্রচণ্ড ধাক্কা। জানি অশোক। পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় যা যা গালাগাল জানতাম, সব কুড়িয়ে-বাড়িয়ে মিনিট দশেক করার পরেও দেখলাম, ও কোনও প্রতিক্রিয়া দিচ্ছে না।
প্রতিক্রিয়া না দেওয়ার জন্যই হয়তো শেষমেশ দরজাটা খুললাম। আর দেখলাম, একটা বেগুনি শার্টে টাইগার পটৌডি!
জীবনে ওই এক বারই নিজেকে জ্যাকেট ছাড়া এস্কিমোদের দেশে আবিষ্কার করেছিলাম। চোখের সামনে শুধু বেগুনি নয়, লাল-হলুদ-নীল নানান রংয়ে পৃথিবী ঘোরা শুরু হল। কাল সকালে তো এই লোকটা অনিবার্য ফোন তুলবে আর আনন্দবাজারের অপারেটরকে লং ডিসট্যান্স কলে বলবে, ক্যান আই স্পিক টু অভীক?
আমার চাকরিটা গিয়েছে, এই প্রবল বিশ্বাসের মধ্যেও তোতলাতে তোতলাতে ক্ষমা চেয়ে পটৌডিকে বললাম, বিশ্বাস করুন, এটা অশোকের জন্য। আপনি যে থাকতে পারেন, স্বপ্নেও ভাবিনি। পটৌডি কোনও হেলদোলই দেখালেন না। বললেন, “পৃথিবীতে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটছে। যেমন আমি এখন জানতে চাইছি, অশোক কি একটাও সিগারেটের প্যাকেট ফেলে গিয়েছে?” ঈশ্বরের অসীম সৌভাগ্য যে, একটা প্যাকেট পাওয়া গেল। একটায় টান দিয়ে পটৌডি খানিক ফুরফুরে হলেন। কিন্তু এত রাত্তিরে তিনি কী করছেন? নির্বিকার ভাবে বললেন, “বেগম সাহেবার হিরের আংটি বেসিনের ঝাঁঝরি দিয়ে গলে গিয়েছে। আমি সেটা তদারক করতে নীচে গিয়েছিলাম, কোথাও আটকে আছে কি না।” পরে জেনেছিলাম, ওটা অর্ধসত্য। প্রিয় হিরের আংটির বিসর্জনে চরম বিপন্ন শর্মিলা স্বামীকে বলেছিলেন, “শিগগির নীচে প্লাম্বিংয়ের লোককে ডাকো। পাইপের মুখে যদি ওটা আটকে থাকে।” পটৌডি যাচ্ছি বলে নেমেছিলেন, কিন্তু সেটা আংটি অন্বেষণে নয়, সিগারেটের আকুতিতে!
প্রায় দু’হাজার আটশো রান আর চল্লিশ টেস্টের অধিনায়কত্ব দিয়ে টাইগার পটৌডিকে ব্যাখ্যা করা তাই অসম্ভব। পটৌডি ছিলেন প্রকৃত অর্থেই অনন্য। এমন একটা সময় আর জীবনচর্চার তিনি প্রতিনিধিত্ব করেছেন যে, ইতিহাসের আপন খেয়ালও তাঁর দ্বিতীয় সংস্করণ ঘটাতে পারবে না। জীবনের যাবতীয় ট্র্যাজিক ঘটনা
ক্রিকেট লেখকদের এই আন্ডারস্টেটমেন্টের দায় বহন করার কোনও পবিত্র দায় নেই। তারা জেনে গিয়েছে, যত দিন ভারতীয় ক্রিকেট থাকবে, সোনার হরফে শায়িত থাকবেন পটৌডি। নিয়তিরও সাধ্য নেই, এখানে তাঁর একটা চোখ কেড়ে নেওয়ার! |
|
|
|
|
|