|
|
|
|
দত্ত বাড়ির পুজোয় সাবেকিয়ানাই প্রাণ |
কিংশুক আইচ • খড়্গপুর |
তিনটি বাঁশ দিয়ে তৈরি একটা তেপায়া। তার উপরে পেল্লাই এক চালকুমড়ো রাখা। প্রায় ১০০ মিটার দূরে হাতে তির-ধনুক হাতে প্রস্তুত তিরন্দাজের দল। একে একে চালকুমড়োটিকে নিশানা করে তির ছুড়লেন তাঁরা। একজন লক্ষ্যভেদ করতেই সমবেত জনতা চেঁচিয়ে উঠল ‘দুর্গা মাইকি জয়’। কর্তাব্যক্তি স্থানীয় এক জন এ বার নতুন ধুতি হাতে এগিয়ে এলেন। ধুতিটিকে পাগড়ির মতো করে পেঁচিয়ে দিলেন লক্ষ্যভেদকারী তিরন্দাজের মাথায়। এরপর দল বেঁধে জনতা চলল দত্ত বাড়ির দিকে।
১৬০ বছর ধরে এই প্রথা পালিত হচ্ছে খড়্গপুরের মালঞ্চ এলাকার দত্ত বাড়ির দুর্গাপুজোয়। বিজয়া দশমীর বিকেলে আয়োজন করা হয় তিরন্দাজি প্রতিযোগিতার, নাম ‘কুমড়ো বেঁধা’। চালকুমড়োয় তির না বেঁধা পর্যন্ত বিসর্জনের শোভাযাত্রা বেরোয় না। আগে সাঁওতাল-আদিবাসীরা দল বেঁধে এই প্রতিযোগিতায় যোগ দিতে আসতেন। তবে কয়েক বছর হল আর প্রতিযোগীতা হয় না। প্রথা মেনে প্রতীকী তির ছোড়া হয়। সেই তির চালকুমড়োর বেঁধার পরই শুরু হয় নিরঞ্জনের শোভাযাত্রা। এমনই নানা প্রথা আর রীতি-নীতিতে স্বতন্ত্র দত্ত বাড়ির দুর্গোৎসব। দত্ত পরিবারের জমিদারি ছিল খড়্গপুরের দেওয়ান মাড়ো মৌজায়। তার আগে পরিবারের সদস্যরা জকপুরের কোথাও ছিলেন। ১৬০ বছর আগে মালঞ্চয় এসে জমিদারি পত্তন করেন তাঁরা। তার আগেও দত্ত বাড়িতেও দুর্গাপুজ়োর চল ছিল। তবে সেই ইতিহাস এখন বিস্মৃতির আড়ালে। |
|
(ছবি পারিবারিক সংগ্রহ থেকে) |
প্রতিমা গড়া থেকে বিসর্জন সবেতে একটা নিজস্বতা রয়েছে এই পুজোর। উল্টোরথের দিনে তুলসি মঞ্চ থেকে রুপোর পাত্রে রুপোর টাকা দিয়ে সামান্য মাটি সংগ্রহ করা হয়। মন্দিরে পুজোর পরে সেই মাটি যত্নে রেখে দেওয়া হয়। জন্মাষ্টমীর দিন সেই মাটি কাঠামোতে ছুঁইয়ে শুরু হয় প্রতিমা নির্মাণ। মাটির পাত্র যেখানে রাখা হয়, সেখান থেকে রীতিমতো শোভাযাত্রা করে তা নিয়ে যাওয়া হয় দুর্গামন্দির পর্যন্ত। বাড়ির পুরুষ সদস্যরা জল ছড়াতে ছড়াতে সামনে যান। পুজো হয় পুরোপুরি গোস্বামী মতে। পঞ্চমী থেকে দশমী বাড়ির সকলে নিরামিষ খান। একচালার ছোট প্রতিমা। তবে বৈশিষ্ট্য হল প্রথম থেকে একই কাঠামোয় ঠাকুর গড়া হচ্ছে। প্রাচীনত্ব অন্যত্রও। পারিবারিক প্রথা মেনে পুজোর সময় যে তিনটি ঢাক ও একটি ঢোল, তার মধ্যে একটি ঢাকের বয়স ১০০ বছরেরও বেশি।
পরিবারের সদস্য শান্তিপদ দত্ত জানালেন, বাড়ির সকলে মিলেই পুজোর আয়োজন করেন। পালা করে পুজোর চল এখানে নেই। প্রতিমার একচালার চারপাশের শোভা পায় পেতলের গয়না। দেবীর অস্ত্রও ধাতব। অষ্টমীতে দুর্গার হাতে রুপোর চাঁদমালা পরানোর রীতি রয়েছে। এককালে পশুবলির প্রথাও ছিল। কিন্তু এখন আর হয় না। জনশ্রুতি, বহুদিন আগে সন্ধিপুজোর পরে যখন বলির সময় আগত, তখনও এসে পৌঁছননি বলি দেওয়ার লোক। সবাই যখন খুব চিন্তিত, তখনই এক জন খড়্গ হাতে হাজির হলেন। জানালেন তিনি বলি দিতে চান। বলিদান-পর্ব মিটল। কিন্তু যিনি বলি দিতে এসেছিলেন, হঠাৎই তিনি খড়্গ রেখে ‘হাত-মুখ ধুতে যাচ্ছি’ বলে বেরোন। আর ফিরে আসেননি। সেই থেকে পরিবারের সদস্যদের ধারণা হয়, দেবী নিজেই পশুবলি চান না। তবে বলিদানের খড়্গটি আজও দত্ত বাড়িতে যত্নে রাখা আছে। এককালে পুজোর ক’দিন যাত্রা-কবিগানের আসরে সরগরম হত গোটা চত্বর। এখন সেসব না হলেও প্রতি সন্ধ্যায় শিবায়ন পাঠ হয়।
ঐতিহ্যের এই পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে সম্প্রীতিও। বেশ কয়েক বছর আগে রূপনারায়ণপুরের টাটার কারখানার জন্য জমি অধিগ্রহণ শুরু হয়। দত্ত পরিবারের কিছু জমিও অধিগ্রহণের আওতায় আসে। তখন পরিবারের সদস্যরা জানান, এই জমি দেবী দুর্গার নামে দেবত্র সম্পত্তি হিসেবে রয়েছে। সরকারি অফিসাররা প্রথমে তা মানতে চাননি। কিন্তু মুসলিম অধ্যুষিত এই এলাকার অধিকাংশ সংখ্যালঘু বাসিন্দা যখন দত্ত পরিবারের সঙ্গে সহমত পোষণ করেন, তখন সরকারি কর্তারা তা মেনে নেন। জমি বিক্রির টাকা ব্যাঙ্কে রেখে দেওয়া হয়। তা থেকেই পুজোর আয়োজন করা হয়। সে বার পুজোয় দত্ত বাড়িতে নিমন্ত্রিত ছিলেন ওই সব সংখ্যালঘু মানুষজনও।
এক কালের জঙ্গলে ভরা মালঞ্চ আজ ঝাঁ চকচকে। চারপাশে আধুনিক ঘরবাড়ির ভিড়। তারই মাঝে এখনো সাবেকিয়ানায় সমুজ্জ্বল দত্ত বাড়ির পুজো। |
|
|
|
|
|