পিতৃপক্ষের মেলার ক’টা দিনই যা আরাম। কাজ হয়। পয়সাও জোটে। সঙ্গে ফাউ। পিণ্ডের রুটি।
কলা, জবের আটা আর তিল। তার সঙ্গে মধু, ঘি, দুধ বা দই দিয়ে মেখে ছোট ছোট পিণ্ড তৈরি হয়। পিণ্ড সাজিয়ে যাত্রীরা তাতে কুশে করে ফল্গুর জল ছেটায়। প্রার্থনা করে, ‘মধুবাতা ঋতায়তে। মধু ক্ষরন্তি সিন্ধবাঃ...।’
কান খাড়া হয়ে যায় ওদের। ছোট ঝুড়ি নিয়ে ওরা একটু দূরে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। সুর করে পুরোহিত বলেন, ‘ভো পিণ্ডং গায়ং তিষ্ট, পিতৃগণ বিষ্ণুলোকং গচ্ছ।’ মৃতদের উদ্দেশে পিণ্ডদানকারীরা ঠেলে দেয় পিণ্ড। শুরু হয় দক্ষিণা নিয়ে পুরোহিতের সঙ্গে দর কষাকষি। আর সেই ফাঁকে ওঁরা ঝুড়িতে সন্তর্পণে তুলে নেয় পিণ্ডের দলা। ঝুড়ি ভরে গেলেই দ্রুত গতিতে হাওয়া হয়ে যায় এলাকা থেকে। কেউ আসেন গয়ার মারানপুরা থেকে। কেউ বা গলবিঘা, মঙ্গলাদেরি থেকেও। তেতে ওঠা ফল্গুর বালিতে অভ্যস্ত পায়ে ছুটে চলেন এ-দিক থেকে ও-দিক। ঝুড়িতে কুড়িয়ে নেন পিণ্ড। নিয়ে গিয়ে জড়ো করেন এক কোণায়। কারও নাম হীরা, কারও নাম জিতেন্দ্র, কারও বা রেণু। ওঁরা অগ্রদানী নন। নিজেরাই নিজেদের বলেন, আমরা দলিত। মহাদলিত। |
পিণ্ড নিয়ে কী করেন? “সাফাই করি। আর ঝুড়ি করে পিণ্ড বেচে দিই। পোষা গরুকে খাওয়াবে বলে লোকে কিনে নিয়ে যায়।” আর কিছু? হীরার চোখেমুখে সঙ্কোচ, “কী হবে বলে!” লোকে জানলে পরিস্থিতি পাল্টাতেও তো পারে! হেসে ফেলেন হীরা। “আমাদের আবার পরিস্থিতি পাল্টানো। ২৫ বছর ধরে কত কিছুই তো শুনলাম। শুধুই শুনেছি। পাল্টায়নি কিছুই। আমাদের সেই একই হাল।” বিরক্তির মধ্যেই আসল সত্যিটা বেরিয়ে পড়ে। “পিণ্ড তুলে এনে ঝাড়াই-বাছাই করি। ‘টাটকা’ পিণ্ড আলাদা করে রেখে দিই নিজেদের জন্য। বাকিটা বিক্রি করে দিই। গরুকে খাওয়ানোর জন্য লোকে কিনে নিয়ে যায়। ঝুড়ি-প্রতি দাম তিরিশ টাকা। পিতৃপক্ষের মেলার এই সময়টায় ওই বেচে দিনে দেড়শো-দু’শো টাকা তো হয়েই যায়।” দিনের শেষে শুকিয়ে যাওয়া পিণ্ডে জল দিয়ে ফের নতুন করে মণ্ড তৈরি হয়। তৈরি হয় পিণ্ডের রুটি। তিল আছে, মধু আছে, ঘি আছে। খেতে খারাপ হয় না। বাড়ির বাচ্চাদের এই ক’দিন উৎসব চলে। যদি জোটে রোজ, এমনি বিনি পয়সার ভোজ! পিতৃপক্ষের এই ক’টা দিন অনেক ‘আরাম’।
বছরের বাকি সময় মজদুরি করে দিন কাটে হীরাদের। দেড়শোর বেশি রোজ মেলে না। কিন্তু এই সময়ে খাটনি কম। কাটতি বেশি। সঙ্গে ‘টাটকা’ পিণ্ডের রুটি! হীরার নিজের কথায় তাঁরা হলেন সমাজের ‘মাড়িয়ে চলা অংশ’। পোশাকি নাম দলিত। ২০০৫ সালে নীতীশ কুমার ক্ষমতায় আসার পরে দলিত পাল্টে হয়েছে ‘মহাদলিত’।
হীরা বলেন, “প্রথম প্রথম আমরাও আশা করেছিলাম। বলেছিল জমি দেবে, কাজ দেবে, খেতেও দেবে। এখন আর ও সব ভাবি না। বুঝে গিয়েছি, যেমন ছিলাম তেমনই থাকব। তবে হ্যাঁ, মিথ্যে বলব না। এই ক’বছরে নতুন বলতে আমাদের টোলায় স্কুল হয়েছে। কিন্তু স্কুলে যাওয়ার সময় আছে নাকি!” হীরাদের ‘বচপন’ও কেটেছে এই ফল্গুতেই, ‘শুখা’ সময়ে ফল্গুর বালি খুঁড়ে জল বের করে। পিণ্ডদানকারীরা জল নিয়ে দু’পয়সা দিয়ে যায়।
শরীরে ‘তাকত’ একটু বাড়তেই জন-খাটায় নাম লেখায় কিশোররা। তবে পিতৃপক্ষের এই ক’টা দিন একটু অন্য রকম যায়। ভোর হলেই হীরা মা-বউ-ছেলেমেয়েকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়েন। বাবার শরীর খারাপ। এখন আর গায়ে-গতরে খাটতে পারেন না। তাই ‘ভিক্ষের লাইনে’ বসেন। হীরার কথায়, “কেউ জিগ্যেস করলে অতশত বলি না। শুধু বলি, পিন্ডি সাফাই করতে যাচ্ছি। পিন্ডি থেকে রুটি বানিয়ে খাই, বলতে লজ্জা করে।” লজ্জা করে, পেটও ভরে। পিণ্ডের মরসুমে মৃতের পুণ্যে জীবিতের পুণ্য। নইলে খরচ বাড়ে। |