“আবার নাকি ভূমিকম্প হবে?” জিজ্ঞাসা ছিল মঙ্গনের চোখেমুখে। মঙ্গন, রবিবারের ভূমিকম্পের উৎসস্থল। মঙ্গনের আশঙ্কাকে পুরোপুরি সত্যি করে দিয়ে বৃহস্পতিবার রাতে ফের কেঁপে উঠল সিকিমের রাজধানী গ্যাংটক।
এ দিন রাত ১০টা ১৭ মিনিটে আরও এক বার ভূমিকম্পের সাক্ষী হল সিকিম। গ্যাংটকের কেন্দ্রীয় আবহাওয়া দফতর সূত্রে বলা হয়েছে, ১০-১২ সেকেন্ড স্থায়ী হয় ওই মৃদু কম্পন। দফতরের মুখপাত্র গোপীনাথ রাহা বলেন, “রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৩.৯। উৎস গ্যাংটকের কাছেই। তাদুং থেকে ১০-১৫ কিলোমিটার দূরে।” গ্যাংটক শহরের বাজরা সিনেমা হল, একটি আশ্রম এবং লাগোয়া এলাকার কিছু ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে খবর পাওয়া গিয়েছে। তবে পুলিশ প্রশাসনের কাছে এই মুহূর্তে ক্ষয়ক্ষতির চেয়েও মানুষের আতঙ্ক সামাল দেওয়াটাই প্রধান কাজ। আতঙ্ক নিয়েই দিন কাটছিল সিকিমের। চার দিনের ব্যবধানে ফের কম্পনের সামনে পড়ে সেই আতঙ্ক স্বভাবতই আকাশ ছুঁয়েছে। মঙ্গলবার পর্যন্ত রাস্তাতেই ছিলেন। এ দিন আবার পিলপিল করে সেই রাস্তাতেই বেরিয়ে এসেছেন মানুষ। প্রশাসন তাঁদের আশ্বস্ত করে ঘরে ফেরাতে চেষ্টা করছে। |
গ্যাংটকের রাতের ছবিটা যখন এই উদ্ভ্রান্তির, কেমন আছে মঙ্গন? এ দিন সকালে সেখানে গিয়ে দেখা গেল, গোটা শহরটাই আশ্রয় নিয়েছে ত্রাণশিবিরে। অধিকাংশ বাড়ির দরজা-জানলা হাট করে খোলা। লোক দেখলে দরজার আড়ালে লুকিয়ে পড়ছে গেরস্ত বাড়ির নিঃসঙ্গ কুকুর। প্রতিটি বাড়ির নীচের অংশে ফাটলের রেখা। যে কোনও মুহূর্তে ফাটল যেন গিলে খাবে সব ঘরদোর।
মঙ্গনের পথে উত্তর সিকিমের প্রবেশদ্বার ডিপচু জনপদ। পিচের রাস্তা ফেটে চৌচির। গ্রাম পার হতেই লোহার সেতু। তার সামনে রাস্তা থেকে প্রায় ২০ ফুট উপরে পাহাড়ের গা থেকে ঝুলছে একটা বিশাল পাথর। অন্তত সাত ফুট লম্বা। প্রস্থে আরও কয়েক গুণ। ওই পাথর যদি ভেঙে পড়ে? ফের বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে মঙ্গন।
|
শুধু কি পাথরের চাঁই? ডিপচু থেকে মঙ্গনের ১৮ কিলোমিটার রাস্তার বেশির ভাগ জায়গায় পাহাড়ের নীচের অংশগুলো পুরো ধসে গিয়েছে। দেখলে মনে হবে, যে কোনও মুহূর্তে গোটা পাহাড়ই যেন হুড়মুড়িয়ে নেমে আসবে। মঙ্গনের সামনে রংরং গ্রামের পাহাড়েও একই অবস্থা। পাহাড়ের উপর থেকে পাথর-সমেত ঝুলে রয়েছে এক প্রকাণ্ড গাছ। তার নীচে দাঁড়িয়ে ধস সরানোর কাজ করছেন দুই কর্মী। কোনও গাড়ি এলেই হাত দেখিয়ে উপরের দিকে তাকাতে বলে এলাকা পার করাচ্ছেন। পাহাড়ের মেরুদণ্ড ভেঙেছে, গতিপথ বদলে গিয়েছে পাহাড়ি ঝোরার। মঙ্গন থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে একটি কাঠের সেতুর সামনে হঠাৎ নেমে এসেছে একটি ঝর্না। ধসের আঘাতে পথ পাল্টে সরাসরি এসে পড়েছে রাস্তায়। ঝর্নার জলে রাস্তা ভেঙেই চলেছে। আতঙ্কিত বাসিন্দারা কয়েক জন তো বলেই দিলেন, “যা পরিস্থিতি, তাতে ঝর্নার জলের তোড়ে রাস্তাটাই হয়তো ভেঙে যাবে।”
|
মঙ্গন শহরে ঢোকার মুখে চারটি মাত্র স্তম্ভ নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিলিভার চার্চ। দেওয়াল ধসে কয়েকশো ফুট নীচে পড়ে গিয়েছে।
মঙ্গন শহরে ঢোকার মুখে চারটি মাত্র স্তম্ভ নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিলিভার চার্চ। দেওয়াল ধসে কয়েকশো ফুট নীচে পড়ে গিয়েছে। কেবল টিনের চালের টুকরো আর ভাঙাচোরা চেয়ার ক’টা ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছে। এক দশা শহরের প্রাণকেন্দ্রে সাজানোগোছানো উদ্যানটির। উত্তর সিকিমে যাঁরা বেড়াতে যান, তাঁদের অন্যতম পছন্দের জায়গা এই উদ্যান। ভূমিকম্পে তার লোহার সেতু ভেঙে-দুমড়ে একাকার। |
ঘর ছেড়ে পথে:
বৃহস্পতিবার রাতে ফের ভূমিকম্প হয় সিকিমে।
আতঙ্কে ঘর ছেড়েছেন গ্যাংটকের বাসিন্দারা। এম জি মার্গে সন্দীপ পালের তোলা ছবি। |
গ্যাংটক থেকে মঙ্গন পর্যন্ত ধসের ক্ষতচিহ্ন ছড়ানো প্রতি পদে। সেনা জওয়ানরা অত্যন্ত তৎপরতায় ধস সরানোর ফলে কোনও মতে যোগাযোগ সম্ভব হয়েছে। কিন্তু পানীয় জল, বিদ্যুৎ থেকে শুরু করে বাড়িঘর সবই বেহাল। দীর্ঘদিন ধরে মঙ্গনের বাসিন্দা বাঙালি দম্পতি হাবুল দে এবং রাণু দে। বাংলা কাগজের সাংবাদিক শুনে এগিয়ে এসে একরাশ প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন ওঁরাই, “কবে থেকে পানীয় জল পাব? ছেলের স্কুল কবে খুলবে? রান্নার গ্যাস কবে আসবে? আবার নাকি ভূমিকম্প হবে? সবাই বলছে! এ বার কী ক্ষতক্ষতি আরও বাড়বে?”
গোটা পঞ্চাশেক ত্রাণশিবির খোলা হলেও আতঙ্কে হিম গোটা মঙ্গন। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার শিবিরের দায়িত্বে থাকা পিউটুক কাজি বলেন, “যা ঘটেছে তাতে সহজে আতঙ্ক কমার নয়। বিশেষত বাচ্চারা জোরে আওয়াজ শুনলেই কেঁদে ফেলছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে চিকিৎসক এনে ওদের মনোবল বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে।” অদূরে দাঁড়িয়ে এলাকার বাসিন্দা তথা শিক্ষক রবি গুরুঙ্গ বলেন, “যে যে ভাবে পেরেছেন বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছেন। কেউ কেউ সদর দরজায় তালা পর্যন্ত লাগাননি।” |
কেউ নেই কোথাও:
ফের ভূমিকম্পের ভয়ে ঘর ছেড়েছেন সবাই। উত্তর সিকিমের মঙ্গনে সন্দীপ পালের তোলা ছবি। |
খেতে বসে বারেবারেই চোখ মুছছেন চুংথামের সম্পন্ন ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত প্রশান্ত গুরুঙ্গ। থার্মোকলের পাতায় মোটা চালের ভাত। রবিবার দুপুর পর্যন্ত তাঁর বাড়িতে গড়ে ১৫-২০ জন পাত পেড়ে খেত। কিন্তু ভূমিকম্প কেড়ে নিয়েছে সব। এখন ঠিকানা, ত্রাণশিবির। ধসের নীচে চাপা পড়ে থাকা ঘরদোর, দোকান, গাড়ির দিকে তাকিয়ে কথা বলতে গিয়ে চোখের জল আটকাতে পারলেন না। পাশে বসে দোকান-কর্মী কেশব চামলিং, দিনমজুর রুমতি কার্কি সান্ত্বনা দিলেন প্রশান্তকে। ভূমিকম্পের ধাক্কায় সব হারিয়ে এখন মালিক-শ্রমিক একাসনে। সব মিলিয়ে অন্তত এক হাজার মানুষ রয়েছেন শিবিরে। পে লোডার ধস সরাচ্ছিল। পাথর গড়িয়ে কিছুতে ধাক্কা লেগে বিকট শব্দ। আঁতকে উঠে খাওয়া ছেড়ে উঠে পড়লেন অনেকে। মঙ্গনের বাসিন্দা রবিচরণ বললেন, “যা অবস্থা, আকাশে মেঘ ডাকলেও মনে হচ্ছে পালাই। কবে ফের ঘরদোর তৈরি হবে, কী ভাবে হবে, জানি না।” |