“কাছে এল পূজার ছুটি। রোদ্দুরে লেগেছে চাঁপা ফুলের রং...”। স্কুলের জানলার বাইরে তাকালেই ছেঁড়া-ছেঁড়া সাদা মেঘগুলো মনটাকে এলোমেলো করে দিচ্ছে রোজ। ক্লাসে আর এক্বেবারে মন টিকছে না পুপের। ক’দিন পরেই ঢাকে পড়বে কাঠি। পুজোর ছুটির ঘণ্টা বাজতেও দেরি নেই। এখন কি আর ইউনিট টেস্ট দিতে ভাল লাগে?
ঝিলিক-বাবাই-তিতলিও মনমরা। পুজো এসে গেল। কিন্তু এই ক্লাস টেস্ট আর টিউশনের জ্বালায় ঠিকঠাক মজাও করা যাচ্ছে না! যদিও বিকেলের আড্ডায় হাজারটা প্ল্যান বানানো চলছেই। পুজোয় চার দুগুণে আটটা বেলায় সব ঠাকুর দেখে ফেলতে হবে। দশমীটা পাড়ার ভাসানের জন্য বুক্ড। পুপেদের পুজো শুরু তাই ষষ্ঠী থেকে। পঞ্চমী থেকেই শুরু করার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু পঞ্চমী থেকে তো ছুটি দেয় না স্কুলে!
স্কুলবাসে বাড়ি ফেরার সময়ে চোখ আটকাল ‘বেহালা ইয়ং মেন্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর পুজোর হোর্ডিংটায়। আরে! এটা তো একদম পুপেদের মনের কথা! রোজকার দমবন্ধ করা রুটিনের অত্যাচারে প্রাণটা হাঁসফাঁস। নাচ-গান-খেলাও এখন কেমন পানসে লাগে! ‘ইয়ং মেন্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর থিমও তো তা-ই বলছে! তিতিরের বাড়ির কাছেই পুজোটা। ও তাই জানাল, মণ্ডপের প্রবেশপথে থাকবে বই-খাতা-জ্যামিতি বাক্সের আদলে ইনস্টলেশন। আর রোবটের মতো কিছু বাচ্চার মডেল। সর্বশিক্ষার প্রচারে মা দুর্গার হাতে ত্রিশূলের বদলে থাকবে পেন্সিল। যাক্, এরা তা হলে ছোটদের কষ্টটা বুঝেছে। ভারী খুশি পুপে-ঝিলিকরা। এটা দেখতে যেতেই হবে।ব্যস্! বাসের বাকি জার্নিটা সঙ্গে সঙ্গে জমে উঠল যার যার পাড়ার পুজোর গল্পে। সে এক হই-হই কাণ্ড! ঋকের কাছে খবর মিলল, দক্ষিণের ‘রায়পুর ক্লাব’ রবি ঠাকুরের ‘ডাকঘর’-এ অমলের স্বপ্নে দেখা ছেলেবেলায় নিয়ে যাবে সক্কলকে। ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র দেশের ময়ূরপঙ্খী নাও আর পক্ষীরাজ ঘোড়াও থাকবে সেখানে। সেই স্বপ্নের রেশ টানছে ‘পূর্বাচল শক্তি সঙ্ঘ’ও। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছুটতে ছুটতে স্বপ্নরাজ্যে আনাগোনা কি কমে গেছে আজকের ছোটদের? উত্তর খুঁজতে তাই ইলাস্ট্রেশনের মাধ্যমে শিশুমনের স্বপ্ন ও কল্পনা দিয়েই সেজে উঠবে তাদের এ বারের মণ্ডপ। গল্পে গল্পে উঠল ‘সন্তোষপুর ত্রিকোণ পার্ক সর্বজনীন’-এর কথাও। সেখানে এ বার দারুণ রঙিন সব ব্যাপার। থিমটা ‘আনন্দ’। তবে আসল কথা হল, ফুলের আদলে পুজোমণ্ডপ। সেই ফুলের গর্ভে ঢুকলেই ঠাকুর। মা দুর্গা আর তাঁর ছেলেমেয়েদের ফুলেল রঙেরই সাজ। সেই সঙ্গে এ বার মা-বাবাকে টানতে টানতে নিয়ে যেতে হবে ‘উদয়নপল্লি সর্বজনীন’ আর ‘বালিগঞ্জ পূর্বপল্লি’-র মণ্ডপেও। নতুন-পুরনোর মেলবন্ধনকে তুলে ধরছে ওই দু’টো পুজো। ‘বালিগঞ্জ পূর্বপল্লি’ তো পুরো একটা পুজোর মিউজিয়ামই তুলে আনবে। ১৫ জন থিমশিল্পীর তৈরি বিগত বছরগুলোর বেশ কিছু নামজাদা পুজোর টুকরো স্মৃতি থাকবে ওই আর্কাইভে। মণ্ডপটাও তৈরি হবে পুরনো থিমের তালগাছের গুঁড়ি আর ঢাক দিয়ে। আর প্রতিমা? সেকালের ঘটপুজো, এ কালের ফাইবারের প্রতিমা আর চিরকালীন একচালা ডাকের সাজের ঠাকুর বাদ যাবে না কিছুই। ‘উদয়নপল্লি সর্বজনীন (বড়িশা ইয়ংস ক্লাব)’-এর পুজোয় আবার জমিদার বাড়ির আদলে তৈরি হবে মণ্ডপ। পুরনো দিনের আসবাব, সেজবাতি সবই থাকবে মণ্ডপসজ্জায়। যাক্! ঠাকুর দেখার প্ল্যান মোটামুটি সারা, নিশ্চিন্ত হল সবাই। পুপেরা যখন বিকেলের খেলার আড্ডায়, রাতের জন্য আটা মাখতে মাখতে জানলার বাইরে উদাস তাকাল লক্ষ্মী। এ বারও দেশে যাওয়া হল না। বাবা তো পুজোর জামা নিয়ে এল না এখনও, এক মাস ফোনও করেনি। আর এলেও মামি কি ছাড়বে? ২ বছরের ঊর্মিটাকে তো বছর বারোর লক্ষ্মীই সামলায়। লক্ষ্মীর পুজোটা তাই নেহাতই একরঙা, তার জৌলুসও কম। তবু যদি মামি ‘শ্যামপুকুর আদি সর্বজনীন’-এর ঠাকুরটা দেখতে যাওয়ার আগে একবার মনে করে নিয়ে যায়, বড় খুশি হবে লক্ষ্মী। কারণ সেই পুজোটায় রয়েছে আরও অনেক লক্ষ্মীর গল্প। তাদের কেউ কারখানায় কাজ করে, কেউ বা সাতসকালে স্কুলে যাওয়ার বদলে মনিবের বাড়ি বাসন মাজে। স্বপ্নরাজ্যের চাবিটা এখনও হাতে পায়নি তারা। |