এক-এক জন অপেক্ষা করেছিলেন সাত-আট মাস। এমআরআইয়ের তারিখ পেতে।
এবং সেই দীর্ঘ প্রতীক্ষার শেষে নির্ধারিত দিনে বাঙুর ইনস্টিটিউট অফ নিউরোলজি (বিআইএন)-তে এসে তাঁরা শুনলেন, এমআরআই হবে না! কেন হবে না?
কারণ, যন্ত্র কাজ করছে না। বেশ কিছু দিন ধরে।
এমন গুরুত্বপূর্ণ একটা পরীক্ষার যন্ত্র টানা অকেজো?
কর্তৃপক্ষের ব্যাখ্যা, ঘরের ছাদ ফুটো হয়ে জল পড়ছে কি না, তাই যন্ত্র চালানো যাবে না।
কিন্তু এমআরআই করানোর ঘরের ছাদ সময়মতো সারানো হয়নি কেন? ‘হবে কী করে? রোগীকল্যাণ সমিতির বৈঠকই যে বসেনি!’ বললেন কর্তৃপক্ষ।
এ যেন অনেকটা নটে গাছ মুড়োনোর ছড়া। অধিকাংশ সমস্যারই গোড়ায় যেতে হলে বিবিধ কারণের জট ছাড়াতে ছাড়াতে শেষমেশ শুনতে হচ্ছে একই কথা সমিতির বৈঠক বসছে না। যার খেসারত দিচ্ছেন সাধারণ মানুষ। কয়েক দিন আগে যেমন দিয়েছেন বিআইএনে এমআরআই-তালিকায় থাকা দূর-দূরান্তের ওই রোগীরা। তখন ওই হাসপাতালে টানা ক’দিন এমআরআই যন্ত্র অকেজো ছিল বলে কলকাতা এসেও পরীক্ষা না-করিয়ে তাঁদের ফিরে যেতে হয়েছিল।
শুধু বিআইএন নয়। রাজ্যের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে এই দশা। কোথাও অস্থি বিভাগে সি-আর্ম যন্ত্র বিকল, ফলে অস্ত্রোপচার বাতিল করতে হচ্ছে। কোথাও ইউরোসার্জারির সিস্টোস্কোপি, ল্যাপারোস্কোপির হারমোনি স্ক্যালপেল অকেজো হয়ে পড়ে রয়েছে। কলকাতার একাধিক মেডিক্যাল কলেজে চেস্ট বিভাগে ব্রঙ্কোস্কোপির যন্ত্র, ইউরোসার্জারিতে প্রস্টেট অপারেশনের যন্ত্র খারাপ। বিভিন্ন হাসপাতালে গরিব ক্যানসার রোগীদের নিখরচায় যে কেমোথেরাপির ওষুধ দেওয়া হত, টাকার অভাবে সেটাও বন্ধ।
আর সব ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, রোগীকল্যাণ সমিতির বৈঠক হচ্ছে না, তাই এই দুর্দশা। একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আটকে রয়েছে।
স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে, মুখ্যমন্ত্রীর ‘ডু ইট নাও’ কি তা হলে স্রেফ কথার কথা? মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছিলেন, কাজ ফেলে রাখা চলবে না। তাঁর হাতেই স্বাস্থ্য দফতর। সাধারণ রোগীর স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হয়, এমন ঢিলেমি তিনি বরদাস্ত করবেন না বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন মমতা। মহাকরণের পথে প্রায় প্রতি দিনই কোনও না কোনও হাসপাতালে ঢুকে মুখ্যমন্ত্রীর আচমকা পরিদর্শন ওই ঘোষণাকে শক্তপোক্ত করেছিল।
কিন্তু তার পরে?
নিজস্ব সমস্যার দ্রুত সমাধানের লক্ষ্যে বিভিন্ন হাসপাতালে বছর কয়েক আগে তৈরি হয়েছিল রোগীকল্যাণ সমিতি। নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পরে পুরনো সমিতিগুলো ভেঙে দেওয়া হয়। নতুন সমিতি গড়া হলেও তার বৈঠক বসছে না বলে জানিয়েছেন একাধিক সরকারি হাসপাতাল এবং মেডিক্যাল কলেজের কর্তৃপক্ষ ও চিকিৎসকেরা। ফলে ছোট-বড় নানা সিদ্ধান্ত আটকে থাকছে। গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা-সরঞ্জাম কেনা যাচ্ছে না, অকেজো যন্ত্র সারানো যাচ্ছে না, এমনকী, টাকা বরাদ্দ না-হওয়ায় ক্যানসার রোগীদের ওষুধও যাচ্ছে না।
এই পরিস্থিতিতে যারপরনাই ক্ষুব্ধ সরকারি চিকিৎসকমহলের একাংশ। ‘অ্যাসোসিয়েশন অফ হেল্থ সার্ভিস ডক্টরস’-এর সভাপতি গৌতম মুখোপাধ্যায় বলেন, “প্রথম তিন মাস আমরাও নতুন সরকারকে সময় দিয়েছি। কিন্তু দিনের পর দিন এ ভাবে চলতে থাকলে আন্দোলনের পথে যেতে বাধ্য হব। রোগীকল্যাণ সমিতির বৈঠক না-বসায় হাসপাতালের দৈনন্দিন কাজে খুবই অসুবিধে হচ্ছে।”
কেন বসছে না বৈঠক?
এক মেডিক্যাল কলেজের সুপার বলেন, “পুরনো সমিতি ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। তার পরে নতুন সমিতি তৈরির নির্দেশ জারি হল ঠিকই, কিন্তু তার ক্ষমতা কত দূর, তা বলা হল না। এখন বৈঠক ডাকা মানে তো প্রহসন!” বৈঠক না-হওয়ায় কী কী ক্ষতি হচ্ছে?
তিনি বলেন, “পদাধিকারবলে কোনও মেডিক্যাল কলেজের সুপার সংশ্লিষ্ট রোগীকল্যাণ সমিতির সদস্য-সচিব। জিনিপত্র কেনা বা অন্যান্য খরচের বিষয়ে তাঁর একক ক্ষমতা সীমিত। যেখানে সমিতির বৈঠকে পাশ হলে সরঞ্জাম খরিদ, তার বার্ষিক রক্ষণাবেক্ষণ কিংবা বাড়ি মেরামতির মতো বহু গুরুত্বপুর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া যেত। এই মুহূর্তে সব আটকে রয়েছে। বহু যন্ত্রপাতি মাসের পর মাস খারাপ, অথচ আমাদের কিছু করার নেই!”
সমিতির ক্ষমতা নির্দিষ্ট করা হবে কবে?
স্বাস্থ্য-কর্তাদের কাছে এর সদুত্তর নেই। সমস্যা এখানেই শেষ নয়। এই মুহূর্তে রাজ্যে চারশোরও বেশি শিক্ষক-চিকিৎসক পদ খালি। আরও কয়েকশো শিক্ষক-চিকিৎসকের পদোন্নতি আটকে। ফলে মেডিক্যাল কলেজগুলোয় পঠনপাঠনের মান শিকেয় উঠেছে বলে অভিযোগ। উপরন্তু পরিকাঠামোয় এই বিপুল ঘাটতি মেডিক্যাল কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া (এমসিআই)-র ছাড়পত্রলাভের পথেও বড়সড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে বলে স্বাস্থ্য-কর্তাদের একাংশের আশঙ্কা। এক মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষের কথায়, “এমসিআইয়ের নিয়ম অনুযায়ী কোনও মেডিক্যাল কলেজের একটি বিভাগে যত জন প্রফেসর থাকা দরকার, আমাদের তা নেই। পদোন্নতির পরে প্রফেসর বাড়বে ভাবা হয়েছিল। এখন যা পরিস্থিতি, তাতে কবে পদোন্নতি হবে কেউ জানে না!”
এই অবস্থা কেন?
রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের আশ্বাস “পদোন্নতির প্রক্রিয়া দ্রুত শুরু হবে। আর নিয়োগের ব্যাপারটা পুলিশ ভেরিফিকেশনের জন্য আটকে আছে। আশা করি, শিগগিরই মিটে যাবে।” |