মাওবাদীদের সঙ্গে তৃণমূল জোট পরিচালিত রাজ্য সরকারের ‘শান্তি আলোচনা’র সম্ভাবনা বড়সড় ধাক্কা খেল মঙ্গলবার। ঝাড়গ্রামের সাপধরা অঞ্চলে শাসক দলের অঞ্চল সভাপতি লালমোহন মাহাতো (৪৫) খুন হলেন মাওবাদীদের হাতে। শিলিগুড়ি থেকে ভূমিকম্প-বিধ্বস্ত সিকিম রওনা হওয়ার আগে সকালেই সে খবর পৌঁছয় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। গত ২৪ অগস্ট ঝাড়গ্রামেরই পাটাশিমুলে দলের স্থানীয় নেতা রবীন্দ্রনাথ মিশ্র খুনের পরে এক দফা রুষ্ট হয়েও ‘রয়েসয়ে’ চলতে চেয়েছিলেন মমতা। কিন্তু এ দিন দলের জনপ্রিয় আঞ্চলিক নেতা খুনের খবরে তাঁর ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। প্রশাসনিক-স্তরে মাওবাদীদের বিরুদ্ধে ‘সব রকমের ব্যবস্থা’ নেওয়ার বার্তা দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। মাওবাদীদের খুনের রাজনীতির বিরুদ্ধে জনতাকে সংগঠিত করার নির্দেশ দিয়েছেন দলের রাজ্য ও জেলা স্তরের নেতাদের।
মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, “খুনের রাজনীতি চলতে পারে না। আলোচনার নাম করে খুনোখুনি চলবে, তা হবে না। যারা খুনখারাপি চালাচ্ছে, তারা কাপুরুষ। তাদের সংযত হতে বলছি। না হলে মানুষ কিন্তু জবাব দেবেনই।” মানুষকে সঙ্গে নিয়ে মাওবাদী-রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রচার তুঙ্গে নিয়ে যেতে দলনেত্রীর নির্দেশে এ দিনই সাংসদ তথা যুব তৃণমূলের রাজ্য সভাপতি শুভেন্দু অধিকারী, পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন মন্ত্রী সুকুমার হাঁসদা, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা তৃণমূল সভাপতি দীনেন রায় সাপধরায় যান। আর প্রশাসনিক স্তরে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ অনুযায়ী লালমোহন-খুনে অভিযুক্তদের চিহ্নিত করে অবিলম্বে গ্রেফতারের জন্য অভিযান শুরু করেছে পুলিশ। |
মঙ্গলবার সকাল সওয়া ৬টা নাগাদ সাপধরার কুণ্ডলডিহিতে নিজের একটি কোচিং সেন্টার থেকে পাশেই আর একটি সেন্টারের দরজা খুলতে যাচ্ছিলেন লালমোহনবাবু। দু’টি মোটরবাইকে পাঁচ যুবক এসে তাঁর গতিরোধ করে। তাঁকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যেতে চায় ওই যুবকেরা। লালমোহনবাবুর সঙ্গে তাদের ধস্তাধস্তি হয়। তার পরেই আততায়ীরা .৯ এমএম পিস্তল থেকে গুলি চালায়। একটি লালমোহনবাবুর বাঁ হাত ছুঁয়ে বেরিয়ে যায়। পরের গুলিটি লাগে তাঁর কপালে। পিচ রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়েন ওই তৃণমূল নেতা। ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়। পাঁচ যুবক মোটরবাইকে চড়ে আরও এক রাউন্ড গুলি ছুড়ে এবং ‘মাওবাদ জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিতে দিতে চম্পট দেয়। যাওয়ার আগে নিহতের দেহের পাশে রেখে যায় একাধিক পোস্টার। সিপিআই মাওবাদী-র নামে সেই পোস্টারে লালমোহনবাবুকে অত্যাচারী, ‘ভৈরব বাহিনীর নেতা’ চিহ্নিত করে ‘শাস্তি’ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে ‘ভৈরব বাহিনী’তে যোগ দিলে অন্যদেরও একই পরিণতির হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়েছে।
ঝাড়গ্রামের পরিস্থিতি সামাল দিতে ইতিমধ্যেই সেখানে অতিরিক্ত দু’প্লাটুন ইএফআর পাঠানো হয়েছে। বাড়তি সিআরপি-ও পাঠানো হচ্ছে। জঙ্গলমহলে যাঁদের নামে নির্দিষ্ট মামলা বা অভিযোগ রয়েছে, তাঁদের প্রত্যেককে গ্রেফতারের জন্য জেলা পুলিশের কাছে নির্দেশও পৌঁছে গিয়েছে।
রাজ্য সরকারের এই ‘কঠোর’ অবস্থানের পাশাপাশিই মাওবাদী-শিবির থেকেও আলোচনা ভেস্তে যাওয়ার মতো ইঙ্গিত মিলছে। মাওবাদী-ঘনিষ্ঠ অন্ধ্রপ্রদেশের লেখক-সাংস্কৃতিক কর্মী ভারভারা রাও মঙ্গলবারই জঙ্গলমহল সফরে গিয়ে ফের জানিয়েছেন, যৌথ বাহিনী প্রত্যাহার এবং মাওবাদী সন্দেহে ধৃতদের অবিলম্বে ‘নিঃশর্ত’ মুক্তি দেওয়া না হলে আলোচনা সম্ভব নয়। ‘তিন মাসেই নতুন শাসক দল তৃণমূলের অত্যাচার সিপিএমের তিরিশ বছরের অত্যাচারকে ছাপিয়ে গিয়েছে’ বলে আক্রমণ শানিয়েছেন ভারভারা। পুলিশ-শাসক দলের বিরুদ্ধে তোপ দাগলেও মাওবাদীদের বিরুদ্ধে ওঠা খুন-সন্ত্রাসের অভিযোগকে কিন্তু কোনও গুরুত্ব দিতেই চাননি তিনি। সাপধরায় মাওবাদীদের হাতে তৃণমূল নেতা খুনের ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন। আজ, বুধবার ঝাড়গ্রামের সার্কাস ময়দানে ভারভারাকে সভা করার অনুমতি দেয়নি প্রশাসন। |
এই পরিস্থিতিতে শান্তির পরিবর্তে পুজোর মুখে জঙ্গলমহলের নতুন করে অশান্ত হয়ে ওঠার আশঙ্কাই বাড়ল।
কেন খুন হলেন লালমোহনবাবু?
তৃণমূল সূত্রে বলা হচ্ছে, ছাত্র পড়িয়ে সংসার চালানো লালমোহনবাবু এলাকায় জনপ্রিয় ছিলেন। গরিব পরিবারের ছেলেমেয়েদের বিনা পয়সায় পড়াতেন। এলাকায় মাওবাদী-জনগণের কমিটির ‘জুলুম’-এর বিরুদ্ধে জনমত গঠনে ইদানীং সক্রিয় হয়েছিলেন। আশপাশের ৩১টি গ্রামের বাসিন্দাদের এ জন্য একজোট করে প্রচারও শুরু করেছিলেন।
এ ছাড়াও পুলিশে দশ হাজার নতুন কর্মী নিয়োগ নিয়ে রাজ্য সরকারের সিদ্ধান্তে জঙ্গলমহলের যুবকদের মধ্যে উৎসাহ তৈরি হয়েছে বলে দাবি করে তৃণমূল সূত্রের বক্তব্য, এ ক্ষেত্রেও বেকায়দায় পড়েছে মাওবাদীরা। শাসক দলের স্থানীয় নেতাদের খুন করে ত্রাসের পরিবেশ তৈরি করতে চাইছে তারা। যাতে শুধু পুলিশে নিয়োগই নয়, অন্য উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলোও বানচাল হয়। রাজ্য সরকার অবশ্য উন্নয়ন-প্রকল্পগুলির কাজ ত্বরান্বিত করার জন্যও প্রশাসনিক মহলে স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছে।
লালমোহনবাবুর নিহত হওয়ার খবরে এ দিন ক্ষোভে ফেটে পড়েন এলাকার
মানুষ। মৃতদেহ আটকে বিক্ষোভ শুরু করে জনতা। আইজি (পশ্চিমাঞ্চল) জুলফিকার হাসান-সহ উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্তারা গিয়ে মানুষজনের সঙ্গে কথা বলেন। এলাকায় সিআরপিএফ ক্যাম্প তৈরির প্রতিশ্রুতি দেন পুলিশকর্তারা। তার পরে, বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ ময়না-তদন্তের জন্য দেহটি উদ্ধার করে নিয়ে যেতে পারে পুলিশ।
মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং মাওবাদী নেতা জয়ন্তর নাম করে বলেন, “জয়ন্ত-বাহিনী চার দিকে খুনখারাপি চালাচ্ছে। জনগণের কমিটির নামেও খুন-সন্ত্রাস চলছে।” রাজ্য সরকারের পক্ষে নাগরিক সমাজের কেউ কেউ মাওবাদীদের সঙ্গে শান্তি আলোচনার জন্য যে কথাবার্তা চালাচ্ছেন, এখনই তা বন্ধ করার কথা না বললেও মুখ্যমন্ত্রী কিন্তু মাওবাদীদের বিরুদ্ধে অভিযানে আর খামতি রাখা হবে না বলে দলীয় ও প্রশাসনিকস্তরে স্পষ্ট করে দিয়েছেন। সরকারের নমনীয়তার সুযোগে মাওবাদীরা খুন করলেও নাগরিক সমাজ কেন নীরব, সে প্রশ্ন উঠেছে তৃণমূলের অন্দরেই। এর পরে যৌথ বাহিনীর সর্বাত্মক অভিযান শুরু হলে সেই নাগরিক সমাজের আর ‘রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের’ অভিযোগ তোলার নৈতিক অধিকার নেই বলেও একান্তে মন্তব্য করেছেন একাধিক তৃণমূল নেতা।
|