কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা কৌশিক বসু গত মঙ্গলবার মন্তব্য করিয়াছিলেন, মূল্যবৃদ্ধি প্রশমনের লক্ষ্যে সুদের হার বাড়াইবার প্রচলিত পথটি ছাড়িয়া রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এই বার অন্য উপায় ভাবিলেই ভাল হয়। এই মন্তব্যের তিন দিন পরে, শুক্রবার, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সুদের হার বাড়াইয়াছে। বিভিন্ন ব্যাঙ্ক রিজার্ভ ব্যাঙ্ক হইতে স্বল্পমেয়াদি ঋণ লইলে যে সুদ দিতে হয়, সেই ‘রিপার্চেজ’ বা ‘রেপো রেট’ বাড়িয়া দাঁড়াইয়াছে ৮.২৫ শতাংশ। আঠারো মাসে এই হার দ্বাদশ দফা বাড়িল। এই সিদ্ধান্ত সম্পর্কে শুক্রবার অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের উক্তি: মূল্যবৃদ্ধি উদ্বেগজনক অবস্থায় রহিয়াছে ঠিকই, তবে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক যে ভাবে ঋণের বাজারে চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করিতেছে তাহা আয়বৃদ্ধির পথে বাধা হইয়া দাঁড়াইতেছে। স্পষ্টতই, আর্থিক নীতির উদ্দেশ্য ও বিধেয় সম্পর্কে অর্থ মন্ত্রক এবং রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মতদ্বৈধ আছে। থাকিতেই পারে। কৌশিকবাবু জানাইয়াছেন, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বিভিন্ন মত শুনিয়া আপন সিদ্ধান্ত স্থির করে, সিদ্ধান্তটি তাহারই; বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মতপার্থক্য ভারতীয় গণতন্ত্রের এক অতি বরণীয় চরিত্রলক্ষণ। সত্য কথা। এক কালে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের এই ‘স্বাধীনতা’ ছিল না বলিলেই চলে, সে ছিল কার্যত কেন্দ্রীয় সরকারের আজ্ঞাবহ। এখনও তাহার স্বাধীনতা মার্কিন ফেডারাল রিজার্ভ-এর তুল্য নহে, কিন্তু অতীতের তুলনায় অনেক বেশি। তাহা সুলক্ষণ।
কিন্তু কেন অর্থ মন্ত্রক চাহে না যে, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সুদের হার আর বাড়াক? তাহার কারণ, সুদের হার আরও বাড়িলে বিনিয়োগ বা ভোগব্যয়ের প্রবণতায় বড় রকমের আঘাত আসিতে পারে, তাহার ফলে বাজারে চাহিদা কমিয়া যাইতে পারে। যদি তাহা ঘটে, তবে জাতীয় আয়ের বৃদ্ধি ব্যাহত হইবে। ইতিমধ্যেই আয়বৃদ্ধির হার কমিতেছে, চলতি অর্থবর্ষের প্রথম তিন মাসে, অর্থাৎ এপ্রিল-জুলাই পর্বে আয়বৃদ্ধি ৭.৭ শতাংশে নামিয়াছে, দুই বছরের মধ্যে রেকর্ড অধঃপাত। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা ২০১১-১২ সালে আয়বৃদ্ধির অনুমিত হারটি ক্রমশই কমাইতেছে, ৯ শতাংশের কথা এখন আর কেহই বলিতেছে না, ইদানীং ৭ শতাংশের নামও উচ্চারিত হইতেছে। সুদের হার বৃদ্ধি সেই আশঙ্কাকে সত্য করিয়া তুলিতে পারে। এই কারণেই অর্থ মন্ত্রকের আপত্তি। এই আপত্তি কেবল অর্থনীতির বৃহত্তর স্বার্থের কারণে নয়, আপন বাজেটের ‘ক্ষুদ্র’ স্বার্থের কারণেও আয়বৃদ্ধি প্রশমিত হইলে রাজস্ব কমে, ঘাটতি বাড়ে, রাজকোষ ঘাটতিকে জাতীয় আয়ের ৪.৬ শতাংশে সীমিত রাখিবার যে লক্ষ্য অর্থমন্ত্রী স্থির করিয়াছেন তাহা হইতে বিচ্যুতির আশঙ্কা বাড়ে। এক কথায়, বাজেটের অঙ্ক তছনছ হইয়া যায়। অর্থমন্ত্রীর পক্ষে সে বড় সুখের সময় নয়।
রিজার্ভ ব্যাঙ্ক আপাতত অর্থ মন্ত্রকের আপত্তি শুনিতে নারাজ, কারণ তাহার আশঙ্কা সুদের হার কমাইলে বা না বাড়াইলে চাহিদা অত্যধিক বাড়িতে পারে। এখনও ভারতীয় অর্থনীতিতে এই ধারণা প্রবল যে মূল্যবৃদ্ধি চলিতে থাকিবে। খাদ্যপণ্য এবং জ্বালানি হইতে শুরু করিয়া ক্রমে সব ধরনের পণ্যের দামই ঊর্ধ্বগামী হইয়াছে, ফলে অর্থশাস্ত্রের ভাষায় ‘ইনফ্লেশনারি এক্সপেকটেশনস’ বা মূল্যবৃদ্ধির প্রত্যাশাও প্রবল হইতে প্রবলতর হইয়াছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সেই প্রত্যাশার সঙ্গে লড়াই করিতেছে। সম্ভবত অন্তত আরও এক বার সুদের হার বাড়িবে। ডিসেম্বর মাসের পর মূল্যবৃদ্ধি কমিতে পারে, এই আশা যদি সার্থক হয়, তবে হয়তো রিজার্ভ ব্যাঙ্কও অতঃপর আত্মসংবরণ করিবে। সুতরাং আপাতত ভারতীয় অর্থনীতি একটি উভয়সংকটের সম্মুখীন। এক দিকে, বাজারদর চড়িতেছে; অন্য দিকে, বিনিয়োগ, ভোগব্যয়, উৎপাদন এবং আয়ের বৃদ্ধি স্তিমিত হইতেছে। আর্থিক সংস্কার ত্বরান্বিত হইলে বিনিয়োগ উৎসাহিত হইত, এই উভয়সংকট হইতে পরিত্রাণের একটি সুযোগ মিলিত। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার আপাতত দিন আনে দিন খায়। সংস্কার দূর অস্ত্। |