পাঁচ মাস আগে তাঁর কেন্দ্র যাদবপুরে পদযাত্রা করতে গিয়ে ভিড়ের চাপে উঠতে হয়েছিল হুডখোলা জিপে। যাদবপুরের মোড় থেকে গড়িয়া পর্যন্ত চার ঘন্টার বিশাল মিছিল দেখে কমরেডরা
জয়ের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু ভোটে প্রাক্তন আমলা মণীশ গুপ্তের কাছে ১৭ হাজারেরও বেশি ভোটে হারেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য!
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ভবানীপুর কেন্দ্রের সিপিএম প্রার্থী নন্দিনী মুখোপাধ্যায়ের হয়ে প্রচারে সেই হুডখোলা জিপেই উঠলেন বুদ্ধবাবু। চেতলা পার্ক থেকে শুরু হয়ে আলিপুর রোড, হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের সামনে দিয়ে কালীঘাট রোড ঘুরে মিছিল যখন ভবানীপুরের নর্দান পার্কে শেষ হল, তখন তার আয়তন দেখে কমরেডরা উছ্বসিত! একে অপরের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন। |
গত বিধানসভা ভোটে এই কেন্দ্রে সিপিএম প্রার্থী হেরেছিলেন প্রায় ৫০ হাজার ভোটে। এদিনের মিছিল দেখে সিপিএম নেতাদের একাংশ মনে করছেন, সেই ব্যবধান কমতেও পারে। বুদ্ধবাবু নিজে অবশ্য কোনও মন্তব্য করেননি। জিপ থেকে নেমে সোজা উঠে গিয়েছেন নিজের বুলেটপ্রুফ গাড়িতে। তিনি সম্ভবত জানতেন, মিছিলে স্থানীয় বাসিন্দাদের তুলনায় দক্ষিণ কলকাতার অন্যান্য এলাকার মানুষের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। মমতার ‘খাসতালুকে’ প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীকে দেখতে এলাকার মানুষের মধ্যে অতিরিক্ত কোনও ‘উচ্ছ্বাস’ চোখে পড়েনি। কিছু মানুষ তাঁর হাত নাড়ার জবাবে হাত নেড়েছেন। তাঁর নমস্কারের জবাবে নমস্কার করেছেন। এটুকুই।
প্রার্থী নিজে কী মনে করছেন? নন্দিনীদেবীর বক্তব্য, “সবাই নির্বাচনে লড়ে জিততে। আমিও তাই। কিন্তু এই নির্বাচনের তাৎপর্য আলাদা।” ভোটের ব্যবধান কিছু কমানোই নন্দিনীদেবীর লক্ষ্য। মিছিল দেখে তিনিও খুশি। দলের এক নেতার কথায়, “ক্ষমতায় থাকার সময়েও কখনও এই এলাকায় এত বড় সুসজ্জিত মিছিল করতে পারিনি!” খুশি আয়োজক রবীন দেবও। মমতার বিরুদ্ধে লোকসভা ভোটে তিনি দু’বার হেরেছেন। কিন্তু কালীঘাট এলাকায় এত বড় মিছিল করতে পারেননি। মিছিলে মহিলা এবং এসএফআই কর্মীর সংখ্যাই ছিল বেশি। রবীনবাবুর কথায়, “এই মিছিল দক্ষিণ কলকাতায় দলীয় কর্মীদের সাহস জোগাবে।”
অতীতে নির্বাচনী প্রচারে নেমে জিপ থেকে আশপাশের মানুষের দিকে বুদ্ধবাবু হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। এ দিন তেমন কিছু দেখা যায়নি। জিপের চারপাশে ছিলেন নিরাপত্তা কর্মীরা। প্রায় দেড় ঘন্টার যাত্রাপথে বুদ্ধবাবু বার বার একটাই কাজ করেছেন ফুটপাথ, বাজার কিংবা বহুতল, যেখানেই মানুষ দেখেছেন, হাত নেড়েছেন। নমস্কার করেছেন।
পদযাত্রার সামনে ছিলেন প্রাক্তন মেয়র প্রশান্ত চট্টোপাধ্যায়, প্রাক্তন সাংসদ মহম্মদ সেলিম থেকে সহ কলকাতা জেলা বামফ্রন্ট নেতৃত্ব। তারপরে জিপে প্রার্থীর পাশে বুদ্ধবাবু। তার পিছনে একটি ম্যাটাডরে রবীনবাবু ও কলকাতা জেলার নেতৃত্ব। ছিল মূল্যবৃদ্ধি ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটি ট্যাবলো। রবীনবাবু সহ অন্যরা বার বার মাইকে বলছিলেন, মূল্যবৃদ্ধি, রাজ্য জুড়ে সন্ত্রাস এবং উপ নির্বাচনে মুখ্যমন্ত্রীকে ধাক্কা দেওয়ার কথা।
ভূমিকম্পে মৃতদের প্রতি এক মিনিট নীরবতা পালনের পর চেতলা পার্ক থেকে মিছিল শুরু হয় বিকেল সাড়ে ৫ টায়। প্যারীমোহন রোড, গোবিন্দ্য আঢ্য রোড, আলিপুর রোড হয়ে যখন মিছিল চলছে, তখন অন্ধকার নেমে গিয়েছে। আশপাশের গলির বাতিস্তম্ভে আলো জ্বলে উঠলেও মূল রাস্তার আলো জ্বলেনি। যা দেখে সিপিএমের নেতারা মাইকে বলতে থাকেন, ‘‘আমাদের মিছিল দেখে ওরা ভয় পেয়েছে! তাই রাস্তার আলো নিভিয়ে দিয়েছে।’’
মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় অবশ্য বলেন, “বামফ্রন্টের মিছিলের জন্য আলো নিভিয়ে দেব, এমন মানসিকতা নিয়ে আমরা পুরসভা চালাই না। ভবানীপুরে ওদের এমনই অবস্থা যে দিনেই দেখা যাচ্ছে না! রাতের আলোয় কী করে দেখা যাবে?”
চলার পথে বুদ্ধবাবু মাঝে মাঝে কথা বলছিলেন জিপের পাশে হাঁটতে থাকা এসএফআই নেতা কৌস্তুভ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। যিনি এর আগে আলিপুর বিধানসভা উপ নির্বাচনে দাঁড়িয়ে অধুনা রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিমের কাছে হেরেছিলেন। বস্তি এলাকার চরিত্র,
বামেদের ‘পকেট’, বনেদি বা বড়লোকদের পাড়া ইত্যাদি নিয়ে কথা হচ্ছিল। কালীঘাট রোডে সিপিএম অফিসের সামনে প্রাক্তন বিধায়ক তথা সিপিএম প্রার্থীর নির্বাচনী এজেন্ট ভারতী মুখোপাধ্যায় দাঁড়িয়েছিলেন। বুদ্ধবাবু তাঁকে বললেন, “আপনি উঠে আসুন।” ভারতী অবশ্য রাস্তা থেকেই হেসে হাত নাড়েন।
বুদ্ধবাবুর জিপ চালাচ্ছিলেন পলিটব্যুরোর সদস্য সীতারাম ইয়েচুরির ঘনিষ্ঠ শিখ প্রৌঢ় সোহম সিংহ। ভবানীপুরে নিজের এলাকায় যাত্রা শেষ করে তিনি একগাল হেসে বললেন, “বুদ্ধ’দার মিছিলে লোক হয়েছে! এটাই বড় কথা।” |