ঢাকের তালে আর কী দুলবে কোমর! মণ্ডপে ঢাকিদের সঙ্গে ধুনুচি নিয়ে ছেলেমেয়েরা গলা ফাটানোর সুযোগ পাবে---বলো দুগ্গা মা কি! প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে দিশেহারা জলপাইগুড়ি জেলার অন্তত পাঁচ হাজার ঢাকি। কারণ, নতুন প্রজন্ম যে ভাবে বংশপরম্পরায়ের পেশা ছেড়ে অন্য কাজে চলে যাচ্ছে তাতে ঢাক কে বাজাবে সেটাই এখন বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক রকম ধরেবেঁধে ছেলেদের কাঁধে ঢাক ঝোলাতে হচ্ছে। তাও দু’একটা উৎসবে বাজানোর পরে ওঁরা বেঁকে বসছেন। বলছেন দিনমজুরি খাটব তবু ঢাক বাজাব না। কেন! গৌতম হাজরা, শ্যমল হাজরাদের অনুযোগ, দিনরাত ঢাক বাজিয়ে ন্যায্য মজুরি তো মেলেই না। তার উপরে রয়েছে উপেক্ষা। ঢাকিদের শিল্পীর সম্মান কেউ দিতে চায় না। চাকর-বাকরের মতো ব্যবহার করে। বাপ-ঠাকুরদার মতো মুখ বুজে ওই বঞ্চনা তাঁদের কেউ সহ্য করতে পারছেন না। তাই ঢাক ফেলে কাজের খোঁজে দিল্লি অথবা গুজরাতে পাড়ি দেওয়ার কথা ভাবছেন। নতুন ছেলেদের যন্ত্রণা যে উপেক্ষা করার নয় তা স্বীকার করেন উত্তরবঙ্গ লোকশিল্পী বাদ্যকার সমিতির জলপাইগুড়ি জেলা সম্পাদক ধীরেন হাজরা। তিনি জানান, সংগঠনের নাম লোকশিল্পী বাদ্যকার। কিন্তু কেউ ঢাকিদের লোকশিল্পীর মর্যাদা দেয় না। অথচ ওই মর্যাদা আদায়ের দাবিতে লড়াই আজকের নতুন নয়। কয়েক দশক হয়েছে। অনেক সভা ও মিছিল করেছেন। লোকশিল্পীর সম্মান দিয়ে ঢাক শিল্পকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষার আবেদন রেখেছেন মন্ত্রী থেকে প্রশাসনের কর্তাদের দরবারে। লাভ হয়নি। তাই ক্ষোভ বাড়ছে। ধীরেনবাবুর কথায়, “ঢাক বাজিয়ে যে রোজগার হয় তা দিয়ে সংসার চলে না। তার উপরে যদি সম্মানটুকু কেউ না-দেয় তা হলে কেমন করে শিল্প টিকবে!” গোপাল হাজরা, কালীপদ হাজরার মতো জেলার প্রবীণ ঢাকিরা মনে করেন লোকশিল্পীর সম্মান পাওয়া গেলে সরকারি সাহায্যের কিছু তাঁদের বরাতে জুটতো। বছরে ছয় মাস নানা অনুষ্ঠানে ঢাক বাজে। অন্য সময় বেকার অবস্থায় কাটে। ছয় মাসের রোজগার দিয়ে কোনও মতে বছরভর সংসার চালানোর কথা ভাবতে হয়। অগ্নিমূল্যের বাজারে এটা সম্ভব হচ্ছে না। সরকারি সাহায্যও অধরা। বিপদ ঠেকাতে উত্তরবঙ্গ লোকশিল্পী বাদ্যকার সমিতি দুর্গা পুজোয় ঢাক বাজানোর মজুরি ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা দাবি করেছে। সমিতির জলপাইগুড়ি জেলা সম্পাদক জানান, অসমে ঢাক বাজিয়ে মিলছে ২০ হাজার টাকা। এখানে ৫ দিনে মজুরি দেওয়া হয় ৫ হাজার টাকা। র্পুজোর উদ্যোক্তাদের অনেকে ওই সামান্য মজুরিও দিতে চায় না। অভাবে ডুবে থাকা গোবিন্দ হাজরার মতো ঢাকিদের গলায় তাই খেদ, “যদি ঢাক বাজাতেই হয় অসম, মেঘালয়ে যাব। না-হলে অন্য কাজ করব।” ছেলেদের ওই মনোভাবে প্রবীণরা প্রমাদ গুনছেন। ভাবছেন---এ ভাবে চললে আর কত দিন মণ্ডপে ঢাকির দেখা মিলবে! |