|
|
|
|
|
|
ব্যবহার ভাল যার, শেষ ভাল তার |
ছোটবেলা থেকে অনেক বাবা-মা ছেলেমেয়েদের ভাল ব্যবহার করতে উপদেশ দেন।
এটা আগামী দিনে আমাদের দৈনন্দিন তথা কাজের জীবনে বিশেষ কাজে লাগে।
লিখছেন প্রাইসওয়াটারহাউসকুপার্স সংস্থার‘লার্নিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’
বিভাগের ডিরেক্টর বীর্যেন্দু গুপ্ত |
|
|
ছোটবেলায় আমার মা কয়েকটা কথা খুব বলতেন। এখনও মাঝে মাঝে বলেন। যেমন, ‘ব্যবহারই মানুষের পরিচয়’, ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহু দূর’। আর আমার বাবা বলতেন, ‘বিজু, ভদ্র ব্যবহার কোরো।’ এখনকার বাবা-মায়েরাও নিশ্চয়ই এ ধরনের কথা বলে থাকেন। আর, আমরাও যেমন ভাবতাম, অভিভাবকরা এত জ্ঞান দেন কেন, এখনকার ছেলেমেয়েরাও নিশ্চই সে রকমটাই ভাবে।
আমাদের কর্পোরেট দুনিয়াতেও এই ধরনের উপদেশ প্রাসঙ্গিক। আমরা ‘ভাল ব্যবহার’-এর উপদেশ অহরহ শুনি। এটা এতই গুরুত্বপূর্ণ যে ম্যানেজমেন্ট কোর্সে ‘সংগঠনের আচরণ’ (অর্গানাইজেশনাল বিহেভিয়ার) নামক একটি বিষয়ই আছে। তার আবার নানা রূপ আছে অর্গানাইজেশনাল ডায়নামিক্স’, ‘অর্গানাইজেশনাল সিটিজেনশিপ বিহেভিয়ার’ ইত্যাদি। আচরণ সম্পর্কে বিস্তর পেপার আছে, বহু বই লেখা হয়েছে। আমি এখানে এই ধারণাগুলি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করব না, কারণ সে সব তোমরা নিজেরাই পড়ে নিতে পারবে।
এক জন ম্যানেজারকে কেন ‘বস হিসেবে খারাপ’ বলা হয়? একটা টিমের ম্যানেজার কেন তাঁর কোনও কর্মী সম্পর্কে বলেন, ‘ও অন্য কারও কথা শোনে না, নিজের মত ছাড়া অন্য কোনও মত গ্রহণ করে না’? কিংবা, ‘ওর অ্যাটিটিউড প্রবলেম আছে’? কত বার এমন হয়েছে যে, আমি যা বলতে চেয়েছি, অন্যরা সেটা ধরতে পারেনি, ভেবেছে আমি অন্য কিছু বলছি, এবং তার ফলে আমাকে আবার নিজের কথা বুঝিয়ে বলতে হয়েছে, বোঝাতে হয়েছে, ‘আমি ঠিক ওটা বলতে চাইনি’? আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায় ভুল বোঝাবুঝির কি কোনও অন্ত আছে?
|
|
মা যখন উপদেশ দিতেন, তখন মাঝে মাঝেই বিরক্ত হতাম। কিন্তু পঁচিশ বছরের বেশি বিভিন্ন সংস্থায় কাজ করার পরে এখন খুব ভাল বুঝি, ‘ব্যবহারই মানুষের পরিচয়’ কথাটা কত বড় সত্য। কাজের জগতে পরিপ্রেক্ষিতে, অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কথাটার মানে কী, একটু বলার চেষ্টা করছি।
যে কোনও সংস্থায় কাজ করতে গিয়ে প্রায় প্রতি দিন আমাদের নানা কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। অনেক সময়েই আমাদের এমন পরিস্থিতিতে একটা সিদ্ধান্ত নিতে হয়, কখনও বা সিদ্ধান্ত নেওয়ার দরকার হয় না, কিন্তু আলোচনা করতে হয়। কতটা ভাল ভাবে সেই পরিস্থিতির মোকাবিলা করা যায়, সেটা নির্ভর করে যারা পরিস্থিতির মধ্যে আছে, তারা পরস্পরের সঙ্গে কতটা কার্যকর ভাবে আলাপ আলোচনা করে মীমাংসার চেষ্টা করতে পারে, তার ওপর। এবং সেই কারণেই, আমরা কী বলছি, তার সঙ্গে সঙ্গে কী ভাবে বলছি, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমার মতে, এই কী এবং কী ভাবে, দুটিকে মিলিয়েই আমাদের আচরণ নির্ধারিত হয়। মানে ভাল ব্যবহার মানে পরিস্থিতি অনুযায়ী ঠিক কথা বলা এবং ঠিক ভাবে বলা। এটাই আমার অভিজ্ঞতা।
একটা কথা মনে রাখা খুব জরুরি। আমার ব্যবহার কেমন, সেটা কিন্তু অন্যেরা দেখে এবং বিচার করে। সেই বিচারটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমি মনে করতে পারি, আমার ব্যবহার ভাল, কিন্তু অন্যেরা যদি তা মনে না করে তা হলে বুঝতে হবে আমারই কোথাও একটা গণ্ডগোল আছে।
আমরা যখন কারও সঙ্গে কথা বলি, তখন সেই আদানপ্রদানের মধ্যে তিনটে ব্যাপার থাকে:
(১) কী বলছি, অর্থাৎ কথাগুলো,
(২) কেন বলছি, অর্থাৎ উদ্দেশ্য এবং
(৩) কেমন মনোভাব নিয়ে বলছি, অর্থাৎ অনুভূতি।
কোনও প্রতিষ্ঠানের কর্মী হিসাবে পরিশ্রমী হওয়া যেমন দরকার, তেমনই ‘সুনাগরিক’ হওয়াও দরকার। এবং কোনও প্রতিষ্ঠানের সুনাগরিক হওয়ার জন্য আমাদের এই তিনটি বিষয়েই মনোযোগী হতে হবে। |
|
ব্যক্তিগত এবং পেশাগত ক্ষেত্রে আমরা হামেশাই একটা শব্দ ব্যবহৃত হতে শুনি। ‘ট্রাস্ট’। বিশ্বাস। যেমন, অনেক সময়েই কারোর সম্পর্কে বলতে গিয়ে আমরা বলে থাকি ‘আমি ওকে বিশ্বাস করি’ বা ‘আমি ওকে বিশ্বাস করি না।’ বিশ্বাস বা অবিশ্বাস কোনও ব্যক্তির প্রতি আমাদের এই সিদ্ধান্ত অনেকটাই তার আচরণের ওপর নির্ভর করে। কোনও সংস্থা ও তার কর্মীদের ক্ষেত্রে এই ট্রাস্ট বা বিশ্বাসের অর্থ কী, সেটা এক বার দেখে নেব।
যে কোনও বিবাদের ক্ষেত্রে একাধিক ব্যক্তি যুক্ত থাকে। আর সেই বিবাদের থাকে একটা বিষয়। তোমার আর আমার মধ্যে বিবাদ হলে তুমি তোমার মতো করে সেটা মীমাংসা করার চেষ্টা করবে। আর আমি আমার মতো করে। সে ক্ষেত্রে কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল, কী ভাবে বিষয়টা মোকাবিলা করা যায় এই নিয়েই আমরা অনর্গল তর্ক করে যাব। কিন্তু একে অপরের প্রতি বিশ্বাস থাকলে বিষয়টা আমরা যুগ্মভাবে খুব সহজেই মিটিয়ে ফেলতে পারব। ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহু দূর’ মায়ের এই কথাটির অন্তর্নিহিত অর্থটা এখন তাই বেশ উপলব্ধি করতে পারি।
একে অপরের ওপর যে বিশ্বাসের কথা বলছিলাম, উপরের মডেলটা সেই সূত্রেই দেওয়া হল। তবে এটা কিন্তু আমার নয়। উইলিয়াম ইউরি, রজার ফিশার ও ব্রুশ প্যাটন-এর লেখা গেটিং টু ইয়েস বইটিতে আমি এই একই ধরনের একটা ধারণার কথা পড়েছিলাম।
আমি যেমন অপর ব্যক্তির কাছ থেকে ভদ্র ব্যবহার আশা করব, তেমনই সে-ও একই আচরণ আশা করবে আমার থেকে। আর এটা যদি আমরা করতে পারি, তা হলে সকলেই সকলের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করতে পারবে। আর তাতে সংস্থারই সুনাম বাড়বে। আশা করি, সংস্থার শুভাকাঙ্খী হিসেবে এটা আমাদের সকলের প্রচেষ্টা থাকবে। তা হলে মনে রেখো, ‘তোমার ব্যবহারই তোমার পরিচয়।’ |
|
|
|
|
|