ভাদ্র মাসের সংক্রান্তিতে একটা সময় মানুষের ভিড়ে নবদ্বীপে পা রাখা দায় ছিল। রথ দেখা কলা বেচা দুই-ই হয়ে যেত ওই দিনেই।
এক দিকে ছিল সংক্রান্তির দিনে গঙ্গায় স্নান করে পুণ্যার্জন। আর অন্য দিকে, বরাবরের বড় ব্যবসায়িক কেন্দ্র নবদ্বীপে পুজোর বাজারটাও সেরে ফেলা। নবদ্বীপে সেই প্রাচীন কাল থেকে স্থানীয় স্তরের নানা শিল্পের, বিশেষত বস্ত্রশিল্পের বড় বাজার ছিল। স্থানীয় কারিগরেরা গঙ্গার ধারের এই বাজারেই নিয়ে আসতেন তাঁদের জিনিসপত্র নিয়ে। তার একটি বিশেষ দিন ছিল এই ভাদ্র সংক্রান্তি। গ্রামীণ বাজারের মহোৎসব শুরু হয়ে যেত বিশ্বকর্মা পুজোর দিনেই।
সেই সময় আর নেই। কিন্তু প্রথা পুরোপুরি বদলায়ওনি। নিজের রেডিমেড জামাকাপড়ের কারখানায় দ্রুত হাতে জামা সেলাই করতে করতে পুরনো দিনের কাহিনি শোনাচ্ছিলেন প্রবীণ নিত্যানন্দ মহাপাত্র। তিনি বলেন, “খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। পঞ্চাশ বছর আগেও নবদ্বীপ গমগম করত এই সব দিনে। বিশ্বকর্মা পুজো আর মহালয়ার সকালে গঙ্গায় স্নান করতে যাওয়ার রীতি তো ছিলই। সেই সঙ্গে ছিল, পুজোর বাজারে জিনিসপত্র কেনাকেটার ভিড়।” বহু পরিবার গ্রাম থেকে এসে সকালে গঙ্গায় স্নান সেরে মঠ-মন্দিরে পুজো দিয়ে সারা দিন ধরে নবদ্বীপের বাজারে ঘুরে ঘুরে জামাকাপড় কিনে রাতে কোনও মন্দিরের আরতি দেখে বাড়ি ফিরতেন। কেউ কেউ তেমন সামর্থ্য থাকলে নৌকা ভাড়া করে আনতেন। বাঁধা থাকত ঘাটে। তবে ভাদ্রের বিকেল-সন্ধ্যায় নয়, সাধারণত পরের দিন সকালে সে সব নৌকা ছাড়ত গাঁয়ের উদ্দেশ্যে। বিভিন্ন গাঁয়ের বাবুদের জন্য বাঁধা দোকানও ছিল। তাঁদের কেউ বিশেষ পাড়ের ধুতি ছাড়া পরতেন না। কেউ বিশেষ রঙের শাড়ি খুঁজতেন। কারও জন্য বিশেষ মাপের জামা তৈরি রাখতেন কারিগরেরা।
এখন বাজার মোটামুটি বিশেষত্বহীন। রেডিমেড জামাকাপড়ের এই যুগে কলকাতায় যখন যে ‘ফ্যাশন’ চলে, গাঁ-গঞ্জে তারই প্রচলন হয়ে যায় তার কয়েকদিন পর থেকে। ভয়-আশঙ্কা দূর করে সেই বাজারটাই জমে উঠেছে এ বারও। কিন্তু খুব কিছু আশাব্যাঞ্জক নয় এখনও। বড় দোকান বা শোরুমে যখন পুজোর কেনাকেটা শেষ পর্বে, তখন ছোট দোকানগুলি এখনও ক্রেতার অপেক্ষায়। নবদ্বীপের অন্যতম বড় বাজার রাধাবাজারে অনেকেই ঈদ থেকে মরসুমি বস্ত্র ব্যবসায় নেমেছিলেন। অস্থায়ী দোকানে তাঁদের সম্ভার কিন্তু এখনও অনেক পড়ে রয়েছে। এই রাধাবাজারেই পুজোর মুখে কেনাকেটার ভিড় উপছে পড়ে। এ বার তেমন কোনও ছবি একনও দেখা যাচ্ছে না। এই দোকানিদের বক্তব্য, বৃষ্টিই প্রধানত বাদ সেধেছে। এমনই এক বিক্রেতা ধ্রুব রায় বলেন, “নিম্নবিত্তেরা সমস্যায় পড়েছেন। তাঁদের তেমন রোজগার হয়নি। তাই সেই প্রভাটাই পড়েছে বাজারেও।”
কিন্তু প্রধান বাজারে কোনও ঘাটতি নেই। প্রবীণ রেডিমেড ব্যবসায়ী সুখেন রায় বলেন, “পুজোর বাজার বাঙালির রক্তে। যে যেটুকু পারেন, কেনাকেটা করেন। তাই এই সময় বাজারে ক্রেতা তো বাড়বেই।” তাঁর কথায়, “বিশ্বকর্মা পুজোটাই যেন দুর্গাপুজোর শাঁখে ফু। এরপরই উৎসবের পরিবেশ আস্তে আস্তে তৈরি হয়ে যাবে।”
নবদ্বীপের রেডিমেড জামাকাপড়ের এজেন্ট ব্যবসায়ী সমিতির সহ সম্পাদক মোহন রায় বলেন, “নবদ্বীপ শুধু পুজোর সময়ই নয়, সারা বছর ধরেই বিরাট এলাকা জুড়ে নানা ধরনের রেডিমেড পোশাক সরবরাহ করে। তবে অন্য বারের তুলনায় বাজার ততটা তেজি নয় এ বছর।” |