|
|
|
|
‘নির্বিকার প্রশাসন’ |
গ্যাসের কালোবাজারি, চূড়ান্ত দুর্ভোগে গ্রাহকরা |
সুমন ঘোষ • মেদিনীপুর |
সেই জুলাই মাসে বুকিং করেছিলেন। গ্যাসের সিলিন্ডার পেলেন সেপ্টেম্বরের ১৩ তারিখে!
মেদিনীপুর শহরের বটতলাচকের সুনীল শর্মার দুর্ভোগের কাহিনি এখানেই শেষ হচ্ছে না। বুকিংয়ের দিন পনেরো পরেও যখন গ্যাস পাচ্ছিলেন না, ডিস্ট্রিবিউটরের অফিসে ফোন করে সুনীলবাবু অভিযোগ জানিয়েছিলেন। তখন তাঁকে জানানো হয়, সংস্থার কর্মী নাকি সিলিন্ডার নিয়ে গিয়েও বাড়িতে কাউকে না পেয়ে ফেরত এসেছেন। সুনীলবাবু তো অবাক। তাঁর আশ্চর্য হওয়ার অবশ্য ঢের বাকি ছিল। কয়েক দিন পরে সরাসরি যান ডিস্ট্রিবিউটরের অফিসে। এ বার তাঁকে চমকে দিয়ে জানানো হল‘আপনার সিলিন্ডার তো ডেলিভারি হয়ে গেছে!’ ডেলিভারির প্রমাণ হিসাবে সুনীলবাবু গ্রাহকের স্বাক্ষরিত কাগজ দেখতে চাইতেই সুর বদল ডিস্ট্রিবিউটরের। ভুল স্বীকার এবং কয়েক দিনের মধ্যে গ্যাস পাঠিয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার।
এই অভিজ্ঞতা সুনীলবাবুর একার নয়। মেদিনীপুর-খড়্গপুর শহর জুড়ে, বস্তুত পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা জুড়েই অগুনতি গ্রাহকের এই অভিজ্ঞতা হচ্ছে মাসের পর মাস। বুকিংয়ের পরে সিলিন্ডার পেতে-পেতে গড়ে তিন-সাড়ে তিন মাসও লেগে যাচ্ছে। |
|
গাড়িতে ভরা হচ্ছে রান্নার গ্যাস। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল। |
রান্নার গ্যাস অবাধে খোলাবাজারে বিক্রির জেরেই সাধারণ গ্রাহকের এই ভোগান্তি। বিধিনিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডার ব্যবহার হচ্ছে চার চাকার গাড়িতে। চালান হচ্ছে হোটেল-রেস্তোঁরা, অনুষ্ঠানবাড়িতে। ১৪ কেজি ২০০ গ্রামের সিলিন্ডারের ভর্তুকি-পরবর্তী দাম ৩৯৯ টাকা। বাড়িতে সরবরাহের ক্ষেত্রে ৪০৭ টাকা। বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য নির্দিষ্ট গ্যাস সিলিন্ডার সেখানে ১৯ কেজি ২০০ গ্রাম ওজনের। প্রতিটির দাম ১২৭৫ টাকা। রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডারের চেয়ে পরিমাণে মাত্রই ৫ কেজি বেশি, কিন্তু দাম তিন গুণেরও বেশি। সেই দাম গুনতে কিছু লোকের বেজায় আপত্তি। তাঁদের মধ্যে বাণিজ্যিক ও ব্যক্তিগতদু’ধরনের গাড়ির মালিক রয়েছেন। চোরা-পথেই তাঁদের চলাচল। ১৪ কেজি ২০০ গ্রামের রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে ২০০ টাকা বেশি দিয়ে (অর্থাৎ ৬০০ টাকায়, বাণিজ্যিক সিলিন্ডারের থেকে তাও অর্ধেকের কম দামে) কিনে লাগিয়ে নিচ্ছেন গাড়িতে। ওই পরিমাণ গ্যাসে ৩২০ কিলোমিটার দিব্যি চালানো যায়। মানে, কিলোমিটার-পিছু খরচ ২ টাকারও কম!
সিলিন্ডার-পিছু ‘উপড়ি’ ২০০ টাকার লোভে এক শ্রেণির ডিস্ট্রিবিউটর ও তাঁদের কর্মীরা মিলে খুলে বসেছেন চোরা-বাজার। সরকারি ভর্তুকিযুক্ত (যা জনসাধারণেরই করের টাকা) রান্নার গ্যাস সিলিন্ডার আর রান্নাঘরে পৌঁচ্ছছে না। এই গ্যাস-দুর্নীতি অজানাও নয় গ্যাস সরবরাহকারী সংস্থার কর্তাদের। ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশনের দুর্গাপুর আঞ্চলিক শাখার ম্যানেজার (এলপিজি) স্বপন চট্টোপাধ্যায় বলছেন, “কিছু অসাধু ব্যবসায়ী এই দুর্নীতি চালান। জেলা পুলিশের অপরাধ-দমন শাখা মাঝেমধ্যে তল্লাশি চালায়। আমরাও তল্লাশি চালাই। ধরা পড়লে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়।” কিন্তু তা যে নাম-কা-ওয়াস্তে, সাধারণ গ্রাহক প্রতিদিনের দুর্ভোগেই টের পাচ্ছেন। ডিস্ট্রিবিউটর-সংস্থার লোকজন আবার উল্টে সাধারণ মানুষকেই সচেতন হতে বলছেন। গৌতম মুখোপাধ্যায়, গৌতম পালের মতো কয়েক জনের বক্তব্য, “সাধারণ মানুষ গ্যাস না পেয়ে যদি নিয়মিত অভিযোগ করেন, বেআইনি পথে গ্যাস নেওয়ার চেষ্টা না করেন, তা হলেই সমস্যা মিটবে।”
রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডার সরাসরি গাড়ি-মালিকের কাছে বা হোটেল-রেস্তোঁরায় পাঠানোর বাইরেও গ্যাস-দুর্নীতি চলে নানা পথে। প্রথমত, একটি গ্যাসের সিলিন্ডার থেকে অন্য সিলিন্ডারে গ্যাস ভরার যন্ত্র রয়েছে। প্রতি সিলিন্ডার থেকে কিছুটা করে গ্যাস কমিয়ে নেওয়া হয়। ছাপোষা গৃহস্থ সাধারণ ভাবে সিলিন্ডারের ওজন দেখতে চান না। কেউ দেখতে চাইলে ডিস্ট্রিবিউটরের কর্মী বলেন, ‘এখনই আনছি।’ ফিরে এসে বলেন, ‘অনেক দিন তো ব্যবহার হয়নি। মিটারটা একটু খারাপ হয়ে গিয়েছে। পরের বার ঠিক করে আনব।’ ব্যস, হয়ে গেল! বেশি জোরাজুরি করলে পরের বার গ্যাস পেতে কালঘাম ছোটারও তো ভয় আছে সেই গৃহস্থের।
দ্বিতীয়ত, কোনও গ্রাহকের গ্যাসের বইটি রেখে দেওয়া হল ডিস্ট্রিবিউটরের অফিসেই। তাঁর হয়তো দেড় মাসে একটি সিলিন্ডারের দরকার। আর নিয়ম হল, ২১ দিন অন্তর নতুন সিলিন্ডার বুক করা যায়। প্রতি দেড় মাসে গড়ে একটি বাড়তি সিলিন্ডার গ্রাহকের অজান্তেই তাঁর নামে বুক করিয়ে ডিস্ট্রিবিউটরের ঘর থেকেই সরাসরি চালান করে দেওয়া হয় কালোবাজারে।
খড়্গপুরের খেমাশুলির কাছে আবার ‘গ্যাস-কাটিং’ হয়। তেলের মতোই ‘গ্যাস-চুরি’। গ্যাস বোঝাই ট্যাঙ্কার থেকে সরাসরি সিলিন্ডারে ভরে পৌঁছে যায় অসাধু ব্যবসায়ীর কাছে। যার সঙ্গে খড়্গপুরের মাফিয়াচক্রও জড়িত। এর পর ওই সিলিন্ডার এর পর পৌঁছয় বিভিন্ন পয়েন্টে। যেখান থেকে গাড়িতে গ্যাস ভরা হয়। চোরাই গ্যাস কারবারের লাভের একটা অংশ যায় মাফিয়াদের কাছে। অন্য অংশ অসাধু ব্যবসায়ী, গাড়ির চালক আর পুলিশ-প্রশাসনের মধ্যে ভাগাভাগি হয় বলে অভিযোগ। না হলে আর পুলিশের নজর এড়িয়ে কী ভাবেই বা চলবে গ্যাসের এই কালোবাজারি! |
|
|
|
|
|