|
|
|
|
বুকের ব্যামো ভেবে আঁতকে উঠি |
নিজস্ব প্রতিবেদন |
যেন ভুতের সিনেমা। আচমকাই খাট-আলমারি কেঁপে উঠল, মেঝে নড়ে উঠল, পুকুরের জল ফুলে উঠল, দড়ি ছিঁড়ে পালাতে চাইল গরু। কেউ দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে আছড়ে পড়লেন। কেউ ভাবলেন মাথা ঘুরছে বনবন করে, কারও মনে হল নির্ঘাত হৃদরোগ! এই সমস্ত দৃশ্যের স্থিতিকাল এক মিনিটেরও কম। সম্বিত ফিরতে সবাই বুঝলেন, ভুমিকম্প।
হাওড়ায় বহু মানুষ আতঙ্কে রাস্তায় নেমে আসেন। বাগনান থানার আইসি ভাস্কর দাস বন্ধুর সঙ্গে বসেছিলেন নিজের ঘরে। তাঁর কথায়, “আচমকা দেখি দরজার দু’টি পাল্লা থর থর করে কাঁপছে। চেয়ার নড়ে উঠল। পরিচিতদের ফোন করলাম। সকলে বললেন, ভূমিকম্প হয়েছে।” জগৎবল্লভপুরের পোলগুস্তিয়া পঞ্চায়েতের দিঘিরপাড় এলাকার বাসিন্দা শেখ মোসারফ হোসেনের অভিজ্ঞতাও প্রায় একই রকম। তিনি বলেন, “ঘরের চেয়ার-টেবিল, তক্তোপোষ দুলতে থাকল। বুঝতে পারলাম ভূমিকম্প হয়েছে। বাড়ির সবাইকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসি।” ডোমজুড়ের বাঁকড়ার মোরসেলিন আকন বলেন, “দাওয়ায় বসে গল্প করছিলাম। হঠাৎ দেখি, পাশের গোয়ালঘর থেকে গরুটি চিৎকার করে দড়ি ছিঁড়ে ফেলার উপক্রম করেছে। ঘরের মেঝে দুলে উঠল।” একই অভিজ্ঞতা আমতার খড়িয়পের বাসিন্দা লিয়াকত আলি এবং জয়পুরের চকজনার্দন গ্রামের বাবু হকের। বাগনানের অনেক গ্রামে মহিলারা শাঁখ বাজাতে থাকেন।
উত্তর ২৪ পরগনার ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের সর্বত্রই কম্পন অনুভূত হয়। ব্যারাকপুরের সন্দীপন রায় সোফায় বসেছিলেন। সোফা কেঁপে ওঠায় তিনি ভয়ে উঠে দাঁড়ান। ভুমিকম্প হচ্ছে বুঝতে পেরেই স্ত্রী-মেয়েকে নিয়ে ছুটে বাইরে বেরিয়ে পড়েন। কল্যাণীর বি’ব্লকের বাসিন্দা সুদীপ্ত ঘোষ বলেন, “আচমকাই কাচের গ্লাস পড়ে ভেঙে গেল। উপরে তাকিয়ে দেখি সিলিং ফ্যান দুলছে। ভয়ে অসুস্থ মাকে পাঁজাকোলা করে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসি। কয়েক সেকেন্ড পরেই অবশ্য সব স্বাভাবিক হয়ে যায়।” বসিরহাটের মহকুমাশাসক অনামিকা মজুমদার টিভি দেখছিলেন। তাঁরও অভিজ্ঞতায় ঘরের সব কিছু হঠাৎ দুলে ওঠে। কান্তি দত্ত নামে এক বাসিন্দা জানালেন, চা খেতে খেতে তাঁর হাত থেকে ছিটকে পড়ে কাপ। তখনও গোটা ব্যাপারটা ঠাহর করে উঠতে পারেননি। তবে মিনিট খানেকের মধ্যেই যখন আশপাশের বাড়ি থেকে শাঁখ বেজে উঠতে শুরু করল, তখন কান্তিবাবু বুঝলেন, কাণ্ডটা ঠিক কী ঘটেছে।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার ক্যানিংয়ের বাহিরবেনা গ্রামের গৃহবধূ বিউটি লস্কর চা করছিলেন। তাঁর অভিজ্ঞতা, “হঠাৎই চায়ের পাত্র উল্টে গেল। ভাগ্যিস গরম জল গায়ে পড়েনি।” ক্যানিংয়ের স্টেশনের কাছে তেলেভাজা বিক্রেতা দিলীপ হালদার বলেন, “চপ ভাজছিলাম। কড়াই থেকে তেল উপছে পড়ে গেল। ভ্যাবাচাকা খেয়ে গিয়েছিলাম।” ক্যানিংয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী সমৃদ্ধা হালদার বলে, “পড়ছিলাম। হঠাৎ দেখি, পায়রাগুলো অস্বাভাবিক ছুটোছুটি করছে।”
হুগলির চুঁচুড়ার খাদিনা মোড়ের একটি আবাসনের পাঁচ তলার থাকেন অমিত মজুমদার। তিনি বলেন, “আচমকাই দেখি ঘরের সিলিং পাখা দুলছে। ভেবেছিলাম মাথা ঘুরছে। তার পরে বুঝলাম, মাথা ঘোরা নয়, ভুমিকম্প হচ্ছে। কেননা, ঘরের যাবতীয় আসবাব তখন দুলছিল। ভয় পেয়ে আমার সাত বছরের মেয়ে শিবাঙ্গী কাঁদতে শুরু করে। বিপদ আঁচ করে ফ্ল্যাট থেকে নেমে নিচে চলে যাই। একে একে সব আবাসিকেরাই নেমে আসেন।” হুগলির এক গৃহবধূ স্বপ্না ঘোষের অভিজ্ঞতা, “আমার সাত বছরের ছেলে দেবার্ঘ হঠাৎ দেওয়ালে ধাক্কা খেল। ওকে ধরতে গিয়ে আমিও ছিটকে পড়লাম। তখনই বুঝে যাই ভূমিকম্প হচ্ছে।” ব্যান্ডেল চকবাজারের শিল্পী কল্যাণ মজুমদার নিজের গান রেকর্ড করছিলেন। নিয়ম অনুযায়ী রেকর্ডিংয়ের সময় পাখা বন্ধ ছিল। যদিও, হঠাৎ তিনি দেখেন, সিলিং পাখা ভীষণ ভাবে দুলছে। কল্যাণবাবু বলেন, “ওই ভাবে পাখা দুলতে দেখে ঘাবড়ে গিয়ে গান বন্ধ করে দিই।”
বলাগড়ের সুব্রত মণ্ডল সন্ধের দিকে দোকানে ধূপ-ধুনো দিচ্ছিলেন। বললেন, “হঠাৎ মাথাটা ঘুরে উঠল, পা কেঁপে গেল। ভাবলাম বুঝি হৃদরোগ হয়েছে। মাথাও ঘুরছিল। আঁতকে উঠি। কী করব বুঝতে পারছিলাম না। ভাইকে ডাকলাম। সে-ও বলল কাঁপছে। দোকানের সামনে দাঁড়ানো অন্যরাও সে কথা বলায় হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। বুঝলাম, বুকের ব্যামো নয়। ভূমিকম্প।” |
|
|
|
|
|