যতই তিনি রথযাত্রায় বার হন, লালকৃষ্ণ আডবাণীকে কিন্তু প্রধানমন্ত্রী পদের দৌড়ে রাখছেই না আরএসএস। উল্টে তাঁকে চাপ দেওয়া হচ্ছে, যাতে তিনি নিজের মুখেই এ কথা ঘোষণা করেন। তা হলে কি দাঙ্গার কলঙ্ক মুছে নিজের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে অনশনে বসা নরেন্দ্র মোদীকেই সামনে রেখে ২০১৪ -র জন্য তৈরি হতে চাইছেন সঙ্ঘ নেতৃত্ব? সেখানেও কিন্তু মোদীকে আপাতত পরিস্থিতি বিচারের পরামর্শই দিয়েছে আরএসএস। তবে এই দু’দিনে একাধিক আরএসএস নেতা সমর্থন জানাতে মোদীর অনশন মঞ্চেও গিয়েছেন। পাশাপাশি কিন্তু একটা ভয়ও রয়েছে আরএসএস তথা বিজেপি নেতৃত্বের একাংশের। তা হল, অনশনকে কেন্দ্র করে মোদী বিষয়টিকে যে ভাবে উচ্চগ্রামে নিয়ে যাচ্ছেন, তাতে হিতে বিপরীতও হতে পারে।
কিন্তু বিজেপির এই দুই নেতার ক্ষেত্রে দু’ধরনের মাপকাঠি কেন নিচ্ছেন সঙ্ঘ নেতৃত্ব?
আরএসএস সূত্রের মতে, গত লোকসভা নির্বাচনেই লালকৃষ্ণ আডবাণীকে প্রধানমন্ত্রীর পদপ্রার্থী করা হয়েছিল। কিন্তু তাঁর নেতৃত্বে ভোটে বিজেপির ভরাডুবি হয়। ফলে তাঁকে সুযোগ দেওয়া হয়নি, এমন নয়। পরের লোকসভা নির্বাচন আসতে আসতে আডবাণী প্রায় নব্বই ছুঁয়ে ফেলবেন। ফলে তখন তাঁর পরের প্রজন্মের নেতাদেরই সুযোগ দেওয়া উচিত। সে ক্ষেত্রে নরেন্দ্র মোদী বিজেপির তুরুপের তাস হতে পারেন। কারণ, প্রথমত, মোদীর জনপ্রিয়তা রয়েছে। দ্বিতীয়ত, প্রশাসক হিসাবেই নিজেকে যোগ্য প্রমাণিত করেছেন মোদী। আগামী বছর গুজরাতে বিধানসভা নির্বাচনের পরেই মোদীকে দলের কেন্দ্রীয় স্তরে দায়িত্বে নিয়ে আসার কথাও ভাবছে আরএসএস।
কিন্তু যে হেতু এখনও গুজরাত দাঙ্গার মামলার নিষ্পত্তি হয়নি, ফলে পরের লোকসভা ভোট পর্যন্ত পরিস্থিতি কোন দিকে গড়ায়, তার জন্য অপেক্ষা করতে চায় আরএসএস। বস্তুত, আজ অনশন মঞ্চে বসেই মোদীকে গোধরা পরবর্তী দাঙ্গা নিয়ে প্রশ্নে মুখে পড়তে হয়েছে। সেই ঘটনার নৈতিক দায়িত্ব তিনি নিচ্ছেন কি না, এই প্রশ্ন করা হলে, মোদী কিন্তু সরাসরি জবাব এড়িয়ে যান। তিনি বলেন, “এ সব আবার কী? আমি তো খোলা চিঠিতে বিস্তারিত বলেছি। একটি বিবৃতিও দিয়েছি। তবু আপনারা বিষয়টি টেনেই চলেছেন।” এর সঙ্গে জোট সঙ্গী নীতীশ কুমারের দলের খোঁচা তো আছেই। এ দিনও জেডিইউ নেতা শিবানন্দ তিওয়ারি বলেছেন, “যিনি ছ’কোটি মানুষের ক্ষেত্রে রাজধর্ম রাখতে পারেন না, তিনি ১২৫ কোটির সঙ্গে কী ভাবে ন্যায় বিচার করবেন?” তবে আর এক ধর্মনিরপেক্ষ দল এডিএমকে -র প্রতিনিধিরা এসেছেন অনশন মঞ্চে। যদিও একে জয়ললিতার সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্কের জের বলেই মনে করা হচ্ছে। আবার মোদীকে ঘিরে যে আম -বিজেপি একজোট হতে চাইছে, সেটা বোঝা গিয়েছে বিহারের দুই বিজেপি মন্ত্রীর অনশন মঞ্চে আসা দিয়ে। কাজের জন্য বিহারের উপমুখ্যমন্ত্রী সুশীলকুমার মোদী আসতে পারেননি। তবে তাঁর দুই সহযোগী অশ্বীনী চৌবে এবং প্রেম কুমার এসেছেন সুশীলের বার্তা নিয়ে।
মঞ্চ থেকে তা পড়ে শোনানো হয়। মনে করা হচ্ছে, মোদীর উত্থানে ক্রমাগত হুঙ্কার দিয়ে যাওয়া জেডিইউ -কে এ ভাবেই বার্তা দিল বিজেপি।
তবে প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য দৌড়ে তো শুধু মোদী নেই, অরুণ জেটলি, সুষমা স্বরাজ মায় নিতিন গডকড়ীর মতো নেতাদেরও প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হওয়ার ইচ্ছা রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে আরএসএস ২০১৪ -র জন্য নেতা বাছাই নিয়ে এখনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে চায় না। কিন্তু দিন কয়েক আগে সঙ্ঘের বৈঠকে আলোচনা হয়েছে, আডবাণীকে প্রধানমন্ত্রী পদে ফের তুলে ধরা ঠিক হবে না। আরএসএসের পক্ষে ভাইয়াজি জোশী সে কথা আডবাণীকে জানিয়েও দিয়েছেন। সঙ্ঘ সূত্রের দাবি, আডবাণীও মেনে নিয়েছেন, তিনি রথযাত্রা করলেও প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হওয়ার বাসনা নেই তাঁর। কিন্তু সঙ্ঘ চাইছে, এ মাসের শেষে জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠকে সে কথা আডবাণী নিজেই ঘোষণা করুন।
আডবাণীর রথযাত্রার ঘোষণা করার পরেই মোদী সুপ্রিম কোর্টের রায়কে নিজের ‘জয়’ হিসাবে তুলে ধরে অনশন কর্মসূচি ঘোষণা করে দেন। আডবাণী ভেবেছিলেন গুজরাত থেকেই রথযাত্রা শুরু করবেন। বর্তমানে মোদী যে ভাবে নিজের ভাবমূর্তি শুধরে সংখ্যালঘুদের মন জয় করার চেষ্টা করছেন এবং একই সঙ্গে নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর দৌড়েও এগিয়ে রাখতে চাইছেন, তাতে আডবাণী বিহার থেকেও রথযাত্রা শুরু করতে পারেন বলে খবর। তবে মোদীর অনশন নিয়ে উচ্চগ্রামে প্রচার থেকে সঙ্ঘের একাংশ ভয় পাচ্ছেন, এত বেশি সংখ্যালঘু ‘তোষণ’ করলে হিতে বিপরীত হতে পারে। বিজেপি বা আরএসএস নেতৃত্ব জানেন, আগের মতো আর উগ্র হিন্দুত্ব আঁকড়ে ভোটে জেতা সম্ভব নয়। তাই সম্প্রতি মনমোহন সিংহ সরকারের সাম্প্রদায়িক হিংসা প্রতিরোধ বিল নিয়ে সমালোচনার সময়েও বিজেপি বলেনি, এই বিল ‘হিন্দু -বিরোধী’। বরং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতোই সেটি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে কী ভাবে আঘাত করছে, সেই যুক্তি তুলে ধরেছে। মোদী মুখে যতই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা বলুন, আসলে তিনি হিন্দুত্বের ‘পোস্টার বয়’। তাই আরএসএস মনে করছে, তিনি এখন সংখ্যালঘুর মন জয়ের কথা বলে অনশনকে বাড়তি মাত্রা দিতে চাইলে বিজেপির মূল ভোটব্যাঙ্কে তার আঁচ পড়তে পারে। সামনে উত্তরপ্রদেশ ভোটেও তার প্রভাব পড়বে।
আরএসএসের মুখপাত্র রামমাধব অবশ্য বলেন, “আমরা লালকৃষ্ণ আডবাণীর রথযাত্রার বিরোধিতা তো করছি না। এর আগে বাবা রামদেব কিংবা অণ্ণা হজারের দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলন যেমন আমরা সমর্থন করেছি, আডবাণী যদি দুর্নীতির বিরুদ্ধে যাত্রা করেন তা হলে আমাদেরও তাতে সমর্থন থাকবে। কিন্তু মোদীর অনশন সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে হচ্ছে। তাঁর বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে হচ্ছে।” আরএসএসের ইংরেজি মুখপত্রে মোদীর অনশনের যৌক্তিকতাও তুলে ধরা হয়েছে। আরএসএসের এক নেতার মতে, “গুজরাতে স্থানীয় স্তরে মোদীর সঙ্গে সঙ্ঘের এখনও কিছু সমস্যা রয়েছে বটে। কিন্তু সামগ্রিক ভাবে মোদীর জনপ্রিয়তা ও প্রশাসনিক দক্ষতা কোনও ভাবে অস্বীকার করা যায় না। তৃণমূল স্তরে বহু কর্মী চান, মোদীকে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী করা হোক। কিন্তু এখনই সেই বিষয়টি নিয়ে চূড়ান্ত করার অবস্থায় আসেনি সঙ্ঘ। তিন দিন অনশনের পরে মোদীর ভাবর্মূতি কতটা উজ্জ্বল হবে, তা -ও দেখার বিষয়। কিন্তু মোদীকে একটি সুযোগ আপাতত দেওয়া যেতেই পারে।” |