বিষয় একটাই। ফারাক শুধু প্রকাশে।
কে কী ভাবে বিষয়টাকে দেখছেন, তাতেই বদলে যায় রূপ। সেই দেখাটা যদি হয় নামী শিল্পীদের চোখে, প্রত্যেকটা রূপই তার নিজের মতো করে নজর কাড়ে। ঠিক যেমনটা হয় থিমপুজোর শহরে। এ লড়াইয়েও পুরনো যোদ্ধাদের অনেকের হাত ধরে ঘুরেফিরে আসে একই বিষয়। তবে ভাবনার নিজস্বতায় নতুন নতুন রূপে।
ভিন্ন চোখে দেখা প্রকৃতির রূপ যেমন এ বার শহরের তিন নামী শিল্পীর ভাবনায়। পুজোর বাজারে দীর্ঘদিন দাপিয়ে বেড়ানো অমর সরকারের হাত ধরে সল্টলেকের এ জি ব্লকের থিমে মানুষ ও প্রকৃতি। মানবসভ্যতার সঙ্গে প্রকৃতির যোগাযোগকে ঘিরেই এ পুজোর ভাবনা, জানালেন অমর। আর এক নামী শিল্পী সনাতন দিন্দার ভাবনায় আবার বড় হয়ে উঠেছে প্রকৃতির নারীসত্ত্বা। নারীরূপী প্রকৃতির সঙ্গে পুরুষের মিলন তাই থিম হয়ে উঠেছে তাঁর উত্তর কলকাতার নলিন সরকার স্ট্রিটের পুজোয়। কী ভাবে রূপ পাবে এই ভাবনা? সনাতন বলছেন, “এখানে অসুর পুরুষ আর দেবী প্রকৃতি। প্রকৃতির কাছে পুরুষের নিজেকে সমর্পণই এই পুজোর বিষয়বস্তু।” থিমের ময়দানে আর এক বিশিষ্ট, ভবতোষ সুতারের ভাবনায় পূর্ব কলকাতার ‘লেকটাউন অধিবাসীবৃন্দে’র পুজোয় প্রকৃতি এসেছে গাছের রূপকে। গাছের থিমে মণ্ডপ সাজাতে তাঁর আদর্শ বোধিবৃক্ষ।
শহরের দু’টি পুজোয় আধ্যাত্মিকতাও রূপ পেয়েছে দুই পৃথক আঙ্গিকে। দক্ষিণের ‘হিন্দুস্থান পার্ক সর্বজনীন’-এ যেমন তার প্রকাশ কাচের স্বর্গে। এখানেও শিল্পী অমর সরকারই। অমরবাবু এবং পুজো কমিটির এক কর্তা জানালেন, ক্ষণস্থায়ী আনন্দকে চিরকালীন করে রাখার চেষ্টা করে মানুষ। কিন্তু অচিরেই তা ভেঙে যায়। আর তা থেকেই জন্ম নেয় আধ্যাত্মিক বিশ্বাস। এই ভাবনা থেকে তাঁদের কাচের স্বর্গের থিম। এই আধ্যাত্মিকতাই ঢাকুরিয়ার ‘বাবুবাগান’-এ পৌরাণিক ধারণার মোড়কে। পুজোর ময়দানে প্রথম সারির শিল্পী রূপচাঁদ কুণ্ডুর সৃষ্টিতে এখানে শক্তির ৫১ পীঠের পৌরাণিক ধারণার সঙ্গে মিলে গিয়েছে শক্তির ৫১ স্তরের আধ্যাত্মিক ভাবনা। পৌরাণিক ধারণার আর এক অনুষঙ্গ ভবতোষের সৃষ্টিতেও। ‘দমদম পার্ক যুবকবৃন্দে’র মণ্ডপ তাই ডিমের আকারে। যে আকৃতি শিল্পী বেছেছেন পৌরাণিক বিশ্বের ধারণা থেকে।
আধ্যাত্মিকতার পাশাপাশি পুজোয় হাজির বৌদ্ধিক ভাবনার নানা প্রকাশও। লেকটাউনের পুজোয় যখন গাছের থিমেই মিলেমিশে গিয়েছে বোধিবৃক্ষের ভাবনা, যোধপুর পার্কে তখন গড়ে উঠছে সাঁচি স্তূপ। এ পুজোর শিল্পী দীপক ঘোষও পুজোর ভিড়ে নজর কাড়ছেন বেশ কয়েক বছর হল। দীপক বলেন, “বর্তমান সময়ে বুদ্ধের অহিংস নীতি তুলে ধরতেই এ বারের প্রয়াস। মণ্ডপে তুলে ধরা হবে বৌদ্ধ পরিবেশও।” উৎসবের ময়দানে তাই পুরনো যোদ্ধাদের ভাঁড়ারে একই বিষয় ফিরে আসার পাল্লাই ভারী। তবে ভাবনার অদলবদলে অন্য রকম চেহারায়, অন্য স্বাদে। আসলে যাঁর জন্য এত আয়োজন, স্বয়ং সেই মা দুর্গারও যে একই অঙ্গে নানা রূপ। কখনও অসুরদলনী, কখনও গণেশজননী। |