জলে বসানো ‘তামি’ই জানায় সন্ধিপুজোর সময়
|
কোনও ঘড়ি নয়, সন্ধিপুজো শুরু হয় তামার বাটির দিকে নজর রেখেই।
কুলটির মিঠানি গ্রামের চক্রবর্তী পরিবারের দুর্গাপুজোয় কাশিপুর মহারাজার পরিবারের দেওয়া জলঘড়ি বা তামির এমন ব্যবহার চলছে প্রায় চারশো বছর ধরে। আর এই ঐতিহ্যই প্রতি বছর এখানে হাজার হাজার ভক্তকে টেনে আনে।
কি এই জল ঘড়ি বা তামি? চক্রবর্তী পরিবারের প্রবীণতম সদস্য নীলরতন চক্রবর্তী জানালেন, এটি একটি তামার ছোট বাটি। এর তলদেশে একটি ক্ষুদ্র ছিদ্র রয়েছে। এই বাটিটি একটি জলভর্তি পাত্রে বসানো হয়। ছিদ্র দিয়ে জল ঢুকে এক সময় সেটি জলভর্তি পাত্রটিতে ডুবে যায়। এই ভাবে বাটিটি বার কয়েক ডোবার পরে নিদিষ্ট এক সময়ে সন্ধিপুজো শুরু হয়। তামার বাটিটি কত বার ডুবলে সন্ধিপুজো শুরু হবে তা নির্দিষ্ট করেন এই পুজোর গ্রহাচার্য। চারশো বছর আগে যে ভাবে তামার বাটি জলে ডুবিয়ে গ্রহাচার্য এই পুজো শুরু করেছিলেন, এখনও ঠিক সেই ভাবেই গ্রহাচার্যের উত্তর পুরুষ হারাধন চক্রবর্তী পুজো করেন। হারাধনবাবু বলেন, “জোত্যিষ শাস্ত্রের হিসাব-নিকাশ করে ঠিক করতে হয় কত বার তামার বাটি ডুবলে সন্ধিপুজোর শুরু হবে।” আর গ্রামবাসীদের কাছে আশ্চর্যের বিষয় হল পঞ্জিকাতে লেখা সময়ের সঙ্গে হুবহু মিলে যায় এই জল ঘড়ি। |
শুধু তাই নয়, গ্রহচার্য সন্ধিপুজোর মন্ত্র উচ্চারণ করার পরেই তা একাধিক ব্রাহ্মণের মুখে মুখে রিলে হয়ে ছড়িয়ে পড়ে পাশের ধেমোমেন, আলডি, বেজডিহি, পাটমোহনা, ফালাডিয়া গ্রামের একাধিক পুজো মণ্ডপে।
এই পুজোটি এখন গ্রামের সবথেকে বড় সর্বজনীন উৎসব। পরিবারের ষষ্ঠ পুরুষ গোপাল চক্রবর্তী জানালেন, এই গ্রামে এক সময় তাঁদের পূর্ব পুরুষদের খামার বাড়ি ছিল। সেখানে একটি মনকুরকুরি গাছের নীচে মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে প্রায় ৬ ইঞ্চির পিতলের দুর্গা প্রতিমা পাওয়া যায়। এই দুর্গা পরিবারের গণেশ, লক্ষ্মী, কার্তিক, সরস্বতীর দিকটি উল্টো দিকে ছিল। সেই কারণে এখনও ওই ভাবেই মাটির ঠাকুর গড়ে পুজো হয়। ওই পিতলের প্রতিমাটি নতুন একটি চালা মন্দির তৈরি করে মাটির তলায় পুঁতে দেওয়া হয়েছে। এর উপরে বেদি তৈরি করে মাটির দুর্গা প্রতিমা প্রতিষ্ঠা করা হয়। এখনও ওই বেদিতেই প্রতি বছর পুজো হয়। সদস্যেরা জানালেন, সংসার বেড়েছে। আর্থিক স্বচ্ছলতা কমেছে। কিন্তু পুজোর উৎসব এখনও অমলিন। গ্রামবাসীদের পক্ষে গৌতম চট্টরাজ বলেন, “পুজোর চার দিন আমরা ওখানেই ব্যস্ত থাকি। এই পুজো আমাদের গর্ব।” নবীন প্রজন্মের এক জন স্বরুপ চক্রবর্তী বলেন, “এই পুজো আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্য। একে রক্ষা করবই।”
বরাকরের মুখোপাধ্যায় পরিবারের পুজো এ বছর ৮৮ বছরে পড়ল। পারিবারিক পুজো হলেও এখন সেটিও সর্বজনীন উৎসবের ছোঁয়া পেয়েছে। ১৯২৯ সালে এই পুজো শুরু করেছিলেন কুলটি ইস্কো কারখানার মুখ্য ধাতু বিশেষজ্ঞ হরিচরণ মুখোপাধ্যায়। তাঁর অবর্তমানে পরবর্তী প্রজন্ম এই পুজো করে আসছেন। পরিবারের প্রবীণতম সদস্যা শোভনাদেবী জানালেন, ১৩ বছর বয়সে এ বাড়ির বউ হয়ে আসার পর থেকে এই পুজো দেখছি। এলাকার বাসিন্দারা জানালেন, বরাকরে এখন অনেক পুজো হয়। কিন্তু প্রাচীনতম এই মুখোপাধ্যায় পরিবারের সাবেকি এক চালার পুজোর উৎসবে প্রতি দিন আসা চাই। তা না হলে মনই ভরে না তাঁদের। |