চিকিৎসা-বিভ্রাট/৫
রোগীকে তথ্য জানার সুযোগ দেওয়ার দাবি

লায় কই মাছের কাঁটা ফোটায় সিপিএমের নেতা, তৎকালীন বিধায়ক দেবী বসুকে রাতে নিয়ে আসা হল শক্তিনগর জেলা হাসপাতালে। রাত তখন এগারোটা হবে। গলায় অস্ত্রোপচার করতে হবে। কিন্তু চিকিৎসক বুঝলেন, তার আগে প্রবীণ দেবীবাবুর হৃদযন্ত্রের অবস্থা খতিয়ে দেখতে ইসিজি করা দরকার। অথচ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তখন অত কথা শুনতে নারাজ। আশির দশকের সেই গোড়ার দিকে অত রাতে ইসিজি করাও তখন সোজা ছিল না। তার উপরে সিপিএমের স্থানীয় নেতারা তো বটেই, স্বাস্থ্যকর্তারাও হাজির হাসপাতালে। তাঁদের সোজা কথা, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অস্ত্রোপচার করে দিতে হবে। চিকিৎসকও অনড়। শেষ পর্যন্ত ডাক্তারবাবু নিজের উদ্যোগে বাইরে থেকে এক জনকে ডেকে এনে দেবীবাবুর ইসিজি করলেন। তারপরে হল সফল অস্ত্রোপচার।
সেই দিনের সেই চিকিৎসক রমেন্দ্রনাথ সরকার এখন তৃণমূল নেতা। রমেন্দ্রনাথবাবু বলেন, “রোগী যিনিই হোন, তিনি রোগীই। সেই দিন ওই চাপের মধ্যে থেকেও চিকিৎসকের প্রাথমিক কর্তব্যটুকু কিন্তু ভুলিনি। আমি জানতাম, দেবীবাবুকে অজ্ঞান করে অস্ত্রোপচার করতে গেলে তাঁর হৃদযন্ত্রের অবস্থা আমার জানা দরকার। তাই ইসিজি করাতেই হত। জোর করে সেটা আমি করেওছিলাম। দেবীবাবু পুরো সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন, সেটাই ছিল আমার পুরস্কার।”
কিন্তু এই চাপটা সব চিকিৎসক সব সময় রাখতে পারেন না। শুধু রাজনৈতিক নেতাদের ক্ষেত্রেই নয়, পাড়ায় পাড়ায় গণ্ডগোলের প্রভাবও ছোট শহরের হাসপাতালের উপরে এসে পড়ে। নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে জগদ্ধাত্রী পুজোর ভাসানের সময় শহরের দুই বড় ক্লাবের সদস্যদের মধ্যে সংঘর্ষে ছুরিকাহত হন চার জন। হাসপাতালের সুপার ছুটে যান। দু’টো ক্লাবই চাইছিল ওই চার জনকে কলকাতায় নিয়ে যেতে। কিন্তু সুপার তখন দুই ক্লাবের মারমুখী সদস্যদের বুঝিয়ে নিজে দায়িত্ব নিয়ে চার জনেরই চিকিৎসা করান হাসপাতালে রেখেই। তিনি জানতেন, এক জনেরও অবস্থার অবনতি ঘটলে, তাঁকে কেউ ছেড়ে কথা বলবে না। কিন্তু রোগীদের যা অবস্থা ছিল, তাতে কলকাতা পর্যন্ত যাওয়ার ধকল নিতে পারত না।
কিন্তু এই ঝুঁকি এখন সহজে কেউই নিতে চান না। রমেন্দ্রনাথবাবু বলেন, “পাশাপাশি, ডাক্তারবাবুদেরও আর সেই গ্রহণযোগ্যতা নেই যে, তাঁদের কথার উপরে ভরসা করে ঝুঁকি নেওয়া যায়। দেবীবাবু খুব ভাল করেই জানতেন, আমি ডানপন্থী। কিন্তু তখন নিজের প্রভাব না খাটিয়ে অবলীলায় ভরসা করেছিলেন আমার উপরে।” তবে চিকিৎসকদের সংগঠন আইএমএ-র জেলা সম্পাদক অনুপ বসুমল্লিক বলেন, “আমাদের উপরে কিন্তু কোনও রাজনৈতিক দল বা পাড়ার ক্লাব কোনও চাপ দেয় না। তবে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করতে করতে নানা জনের সঙ্গে একটা সম্পর্ক তো তৈরি হয়, সেই কারণেই কখনও কখনও সুপারিশ আসে।”
কিন্তু চিকিৎসা বিভ্রাটের একটা বড় ক্ষত হল দালালচক্র। বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ ওঠে যে, কোনও না কোনও রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায় তারা লালিত-পালিত হয়। কারণ, বারবার চেষ্টা করা সত্ত্বেও দালাল চক্র ভাঙা যায় না। জেলা হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতির প্রাক্তন সভাপতি জেলা পরিষদের সভাধিপতি সিপিএমের মেঘলাল শেখ বলেন, “দালালচক্রের জন্যই রোগী-চিকিৎসক সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায়। ডাক্তারদের সঙ্গে দালালদের সম্পর্ক কিছুতেই ভাঙাও যাচ্ছে না। তবে দালালদের কোনও রাজনৈতিক রং নেই। তারা সুবিধাবাদী শ্রেণি। যখন যে দল ক্ষমতায় তখন সেই দলের ছায়ায় আসার চেষ্টা করে। এদের প্রশ্রয় দেওয়া কারওরই উচিত নয়।” রমেন্দ্রনাথবাবুও বলেন, ‘‘আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি দালালদের। এরা কোনও রাজনৈতিক দলের লোক নয়। স্থানীয় কোনও দাদা খোঁজে ছায়ার আশায়। সেই দাদা সাধারণত কোনও না কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত থাকে।” তাঁর কথায়, “দালালেরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দলের নাম ভাঙানোর চেষ্টা করে। আগে তাদের কেউ কেউ চেষ্টা করত সিপিএমের নাম ভাঙাতে। এখন চেষ্টা করে তৃণমূলের নাম ভাঙাতে।” জেলা হাসপাতালের সুপার কাজল মণ্ডলের বক্তব্য, “দালালেরা রয়েছে, এটা বাস্তব। আমরা নানা সময় এটা ভাঙার চেষ্টা করেছি। কিন্তু দালালচক্র ভাঙতে গেলে যে পরিকাঠামোর দরকার, তা হাসপাতালের নেই। তারা অনেক সময় ডাক্তারদের ভয়ও দেখায়।” অনুপবাবুর কিন্তু দাবি, “যাদের দালাল বলা হচ্ছে, তাদের দিয়ে কিন্তু রোগীরা নানা ভাবে উপকৃত হচ্ছেন। সেটা করেই দালালেরাও কিছু লাভ করছে। তবে চিকিৎসকদের সঙ্গে তাদের কোনও অশুভ আঁতাত নেই।” রোগী-চিকিৎসক সম্পর্ক কিন্তু এত কথার পরেও সুস্থ নেই। নানা জনে নানা দাবি করছেন। কিন্তু ক্ষোভ যে থেকেই যাচ্ছে। এই সমস্যার সমাধান হতে পারে, সম্ভবত হাসপাতালে এমন একটা ব্যবস্থা তৈরির মাধ্যমে, যার সাহায্যে কোন রোগীর কী রোগের কী চিকিৎসা হল, সে কথা সংশ্লিষ্ট সকলেই জানতে পারবেন।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.