মাফিয়া-তাণ্ডব, গুলির লড়াই, নিরীহের প্রাণ সংশয় রেলশহরের পুরনো এই ছবিই ফিরে এল সোমবার। মাতকাতপুরের কাছে এক সময়ের ‘ডন’ বাসব রামবাবুর ‘কনভয়ে’ হামলা হল দিনেদুপুরে। ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ধেয়ে এল আচমকা। তারই মাঝে পড়ে গেলেন বছর চল্লিশের কৃষ্ণকান্ত রায়। গুলি লাগল পেটে। রামবাবুর সঙ্গী ভেঙ্কট রাও-ও গুলিবিদ্ধ হলেন। |
গুলিবিদ্ধ কৃষ্ণকান্ত রায়। |
কৃষ্ণকান্তবাবুর শ্বশুরবাড়ি মাতকাতপুরে। ছেলেকে মেদিনীপুর মেডিক্যালে দেখাবেন বলে ঝাড়গ্রামের খেজুরগেড়িয়ার বাড়ি থেকে এসেছিলেন। এ দিন দুপুর ১২টা নাগাদ ছেলেকে নিয়েই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। ওই পথে যাচ্ছিল মেদিনীপুর আদালত ফেরত রামবাবুর ‘কনভয়’ও। গাড়িতে আসা হামলাকারীদের লক্ষ্য ছিল রামবাবু ও তাঁর দলবলের গাড়ি। কিন্তু তারা গুলি ছুড়তে থাকে এলোপাথাড়ি। পেটে গুলি লাগায় লুটিয়ে পড়েন কৃষ্ণকান্তবাবু। তাঁর শ্যালক গৌর রায় বলেন, “এত জোরে জোরে শব্দ হচ্ছিল, প্রথমে ভেবেছিলাম বাসের টায়ার ফাটল। পরে দেখি রক্তাক্ত অবস্থায় দু’জন পড়ে রয়েছে। তারও পরে বুঝতে পারি, তার মধ্যে একজন আমাদের জামাই।” কৃষ্ণকান্তকে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। শোকবিহ্বল কৃষ্ণকান্তের স্ত্রী সীতাদেবী কার্যত বাগরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন। শ্বশুরবাড়ির অন্যরাও এ নিয়ে বিশেষ কথা বলতে নারাজ।
তবে এ দিনের ঘটনার পরে রীতিমতো সন্ত্রস্ত মাতকাতপুরের মানুষজন। ঘটনাস্থলের অদূরে মাতকাতপুর বাজার। অন্য দিন দুপুর দু’টোতেও ঠাসা ভিড় থাকে। তবে এ দিন স্থানীয় এক ব্যবসায়ীর মৃত্যুর প্রেক্ষিতে বাজার বন্ধ ছিল। ফলে ১২টাতেও এলাকায় লোকজন খুব একটা ছিল না। স্থানীয় ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক অঞ্জন চন্দ বলেন, “ভাবলেই শিউরে উঠছি। যদি বাজার খোলা থাকত তাহলে তো আর কত মানুষ জখম হত। অনেকে হয়তো মারাও যেত।” |
দুই ছেলেকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে তাঁর স্ত্রী সীতা রায়। |
রাত পর্যন্ত এই কথাই ভেবেছে মাতকাতপুর। আর বারবার শিউরে উঠেছে। স্থানীয় বাসিন্দা আরণ্যক আচার্য, কাল্টু রায়দের কথায়, “এখানে প্রায়ই পথ দুর্ঘটনা হয়। অনেকে আহত হন। মৃত্যুও হয়েছে। কিন্তু প্রকাশ্য দিবালোকে এ ভাবে গুলি চলবে, এটা দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি।”
বছর দশেক আগে খড়্গপুর শহর অবশ্য বারবার এমন দৃশ্য দেখেছে। বাসব রামবাবু তখন ত্রাস। রেলের ঠিকাদারি আর লোহালক্কড়ের নিলাম ঘিরে মাফিয়ারাজের একাধিপতি। একাধিক খুনের ঘটনায় নামও জড়িয়েছে তাঁর। গৌতম চৌবে খুনের ঘটনায় গ্রেফতার হয়ে জেলও খেটেছেন। কিন্তু শেষমেশ সুপ্রিম কোর্টে জামিন মিলেছে। গত কয়েক বছর খড়্গপুরেই রয়েছেন রামবাবু। একটা সময় গোটা শহর দাপিয়ে বেড়াতেন। সামনে-পিছনে এসকর্ট নিয়ে ঘুরতেন। অন্ধকার জগতে তিনিই ছিলেন শেষ কথা। তাহলে কি সেই দিন ফিরে আসছে? খড়্গপুরের এক বাসিন্দার কথায়, “এতদিন চুপিসারে মাফিয়ারাজ চলছিল। প্রকাশ্যে আসেনি। সাধারণ মানুষের উপর তার কোনও প্রভাবও পড়েনি। কিন্তু মাতকাতাপুরের ঘটনা জানান দিয়ে দিল, এ বার মাফিয়ারাজ প্রকাশ্যে শুরু হতে চলেছে। তারই মহড়া হয়ে গেল এ দিন।” |
শহরজুড়ে এখন চলছে কানাঘুষো। কিন্তু কেউ প্রকাশ্যে কথা বলতে নারাজ। অন্ধকার দুনিয়ার দখল নিয়ে মাফিয়া-যুদ্ধ কত দূর যায়, সেই আশঙ্কায় ত্রস্ত খড়্গপুরবাসী। পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার প্রবীণ ত্রিপাঠী অবশ্য বলেন, “এ ধরনের ঘটনা যাতে না ঘটে, সে জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কারা এই ঘটনায় জড়িত তারও কিছু সূত্র মিলেছে। সেই মতো তদন্ত চলছে।” |