তার নাম জেসি জেমস। দেড়শো বছর পরে আজও তাকে নিয়ে
উৎসব হয়। এখনই হচ্ছে। হ্যাঁ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে।
অনির্বাণ ভট্টাচার্য |
২০০১, ৯/১১, আমেরিকা কেঁপে গেল এক অভাবনীয় নাশকতার ছাঁটে। দু’দিন আগেই মৌনমুখর হয়ে সেই চিরকালীন ক্ষত’র দিকে ফিরে তাকিয়েছেন ওঁরা, স্মরণ করেছেন সেই ভয়াবহ সকাল। কিন্তু এরই মাঝে একটা উৎসবেও মেতে উঠেছেন ওঁরা অনেকেই। আজ বলতে গেলে, সে উৎসবের সপ্তমী। মার্কিন দেশের মিসৌরি শহরে হচ্ছে ‘জেসি জেম্স ফেস্টিভাল।’ জেসি জেম্স? ঠিক চেনা গেল না? একটু ফিরে দেখা যাক।
১৮৬৩, মার্কিন গৃহযুদ্ধ দু’বছরে পা দিয়েছে। ‘ইউনিয়ন’ বাহিনির ক্রমাগত চাপে ‘কনফেডরেট’রা বেশ বেকায়দায়। দেশের দক্ষিণ দিকের খান এগারো রাজ্য নিয়ে গঠিত এই ‘কনফেডরেট’রা বুঝতে পারছিল, আর বোধ হয় দাসপ্রথা বজায় রাখা যাবে না। কিন্তু অমন হতভম্ব হয়ে বসে থাকলে তো চলবে না, এ লড়াই যে করে হোক জিততেই হবে। স্ট্র্যাটেজি বদলে ওরা গড়ে তুলল গেরিলা বাহিনি। দলে দলে যোগ দিল সব সদ্য ১৬/১৭ পেরোনো ছেলে-ছোকরা। ফ্র্যাঙ্ক জেম্স তাদেরই এক জন। এরা ঘোড়ায় চেপে অতর্কিতে হানা দেয় প্রতিপক্ষ ‘ইউনিয়ন’দের আস্তানায়। তার পর নৃশংস খুন।
দাদা ফ্র্যাঙ্কের দেখাদেখি ওর গুণমুগ্ধ ছোট ভাই জেসি জেম্সও নাম লেখাল এমনই এক গেরিলা বাহিনিতে। ‘ব্লাডি’ বিল অ্যান্ডারসন-এর নেতৃত্বে, এর পর চলল তুমূল লুঠতরাজ। নিরীহ ‘ইউনিয়ন’ সমর্থক’রাও এই চোরাগোপ্তা আক্রমণের হাত থেকে নিস্তার পাননি। কিন্তু এই সবই হঠাৎ থমকে গেল ১৮৬৫ সালে, যখন অ্যাপোম্যাটক্স কোর্ট-এ রবার্ট লি, ‘ইউনিয়ন’ কম্যান্ডার ইউলিসিস গ্রান্ট-এর সামনে আত্মসমর্পণ করলেন। কিন্তু জেম্স ভ্রাতৃদ্বয়? তারা কি হারল?
মোটেও না। প্রমাণ মিলল ১৮৬৬-র ১৩ ফেব্রুয়ারি। মিসৌরি প্রদেশের লিবার্টি শহরে, জেসি ও ফ্র্যাঙ্কের দল দিনেদুপুরে ডাকাতি করল ক্লে কাউন্টি সেভিংস অ্যাসোসিয়েশন-এ। ডাকাতি এর আগেও কি হয়নি? কিন্তু সেগুলো রাতের আড়ালে হয়েছে, আলো থাকতে থাকতে হয়নি। আর এই সংস্থাটিকে টার্গেট করা হয়েছিল এর মালিকের জন্য। মালিক এক প্রাক্তন ‘ইউনিয়ন’ সৈনিক ছিলেন। এই ডাকাতির কথা শুনে, আমেরিকা খানিক বিষম খেলেও, ভেবে নিয়েছিল একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা।
তা যে নয়, সেটা প্রমাণ হল, বছর তিন পর। আবার ডাকাতি, আবার দিনের বেলায়। এ বার, মিসৌরি’র ডেভিস কাউন্টি সেভিংস অ্যাসোসিয়েশন। কারণ সেই প্রতিশোধ। জেম্স’রা জানত যে তাদের গুরু ‘ব্লাডি’ বিল অ্যান্ডারসনের হত্যাকারী স্যামুয়েল কক্স, এই সংস্থার সঙ্গে জড়িত, অতএব...
এই অভিযানে বিশেষ টাকাকড়ি লাভ হল না, স্যামুয়েল ভেবে ওরা জন শিট্স নামক এক ব্যক্তিকে মেরে ফেলল আর অস্ত্র নিয়ে তেড়ে আসা শহরবাসীর মধ্যে দিয়ে আনতাবড়ি গুলি ছুড়তে ছুড়তে পালাতেও বাধ্য হল, কিন্তু আমেরিকা এই পালিয়ে বাঁচার উপর আরোপ করল ছেড়ে আসা কালের রোম্যান্টিকতা। জেসি’র মুখে তারা দেখল সেই আদিম বাঁধনছাড়া মনোভাব। যে মনোভাব একান্তই ‘ওয়াইল্ড ওয়েস্ট’-এর। যে ‘স্পেস’-এ শিল্পবিপ্লবের ছোঁয়াচ পাওয়া যন্ত্র-সভ্যতা, ঘুণাক্ষরেও ঢুকতে পারেনি।
সরকার ওকে ‘আউট-ল’ আখ্যা দিল, আর সাধারণ মানুষের কাছে জেসি নিমেষেই হিরো হয়ে গেল। ওকে অবশ্য যথাযথ সাহায্য করেছিলেন জন নিউম্যান এডওয়ার্ডসও। ভদ্রলোক এক কালে ‘কনফেডরেট’দের হয়ে গৃহযুদ্ধে লড়েছিলেন, পরবর্তী সময়ে ‘কানসাস সিটি টাইম্স’-এর সম্পাদক হয়ে রিপাবলিকান সরকারের বিরুদ্ধে সরব হন। জেসি’র কাণ্ডকারখানা শুনে, জন বোঝেন, একে দিয়ে কাজ হবে। তৈরি হয় নতুন আঁতাত। এর পর জেসি, ফ্র্যাঙ্ক ও অন্যান্যদের নিয়ে যেখানেই ডাকাতি করতে গিয়েছে, একটা প্রেস বিবৃতি সেঁটে, তবেই পালিয়েছে। সে বিবৃতি ছিল ভরপুর ভাবে রাজনৈতিক। তাতে বলা হল, এই ছিনতাইয়ের একটা মানে আছে, একটা মারাত্মক ইঙ্গিত আছে। আর সেটা যত দেরিতে বুঝবে রিপাবলিকান সরকার, তত বিপদ। জন-এর সম্পাদকীয়’র সঙ্গে বেরোতে লাগল দেশকে লেখা জেসি’র একের পর এক খোলা চিঠি। জন-এর কল্যাণে সে তখন রবিনহুড। আর, ডেমোক্র্যাট কনফেডরেটদের ‘রিকনস্ট্রাকশন’-বিরোধী উত্তরও বটে।
কিন্তু এর পরেও, জেসি কোনও রকম রাজনৈতিক মঞ্চে প্রকাশ্যে দাঁড়াল না, উল্টে সন্ত্রাসবাদী ‘কু ক্লাক্স ক্ল্যান’-এর সাদা মুখোশ পরে ট্রেন ডাকাতি করল বহু। ‘নিগ্রো’দের সাবধানও করল, প্রতিবাদ করেছ কি জান খোয়াবে। জেসি ও তার দল তত দিনে আমেরিকান লোকগাথায় ‘কাল্ট’ স্টেটাস পেয়ে গিয়েছে। লোকে তার নাম শুনে ঠকঠক করে কাঁপে, আবার পরমুহূর্তেই কেরামতিও দেখতে চায়। তার পর এক দিন, গ্যাং-মেম্বার বব ফোর্ড জেসিকে পিছন থেকে গুলি করে মেরে ফেলল। বব ভেবেছিল, যাকে নিয়ে দেশ এত দিন ধরে ব্যতিব্যস্ত, তাকে মেরে সে নিজেই নায়ক হয়ে উঠবে। বব তত দিনে দল নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় জেসি-হত্যা নাটক অভিনয় করে বেড়াচ্ছে। কিন্তু বব নিজের দেশকে চেনেনি। ববকেও খুন হতে হল এক দিন, জেসি-হত্যার দায়ে।
আর তাই নিয়ে হলিউড ২০০৭-এ ছবিও বানাল, ‘দি অ্যাসাসিনেশন অব জেসি জেম্স বাই দ্য কাওয়ার্ড রবার্ট ফোর্ড’ (বব, রবার্টের ডাকনাম)। শুধু কি তা-ই? জেসিকে নিয়ে একাধিক কার্নিভাল, মেলা, ফিল্ম-ফেস্টিভাল রমরমিয়ে চলে ও দেশে। মিসৌরি ছাড়াও এমন ফেস্টিভাল হয় মিনেসোটা, লুইসিয়ানা, কেন্টাকি, ইলিনয় সহ কিছু শহরে। জেসি’র মতো তীব্র বেগে ঘোড়া চেপে গুলি চালানোর প্রতিযোগিতা, একের পর এক গাড়ি লাইন করে সেগুলি অন্য গাড়ি দিয়ে ধাক্কা মেরে ধ্বংস করার খেলা, খোলা আকাশের নীচে বারবিকিউ আর অবশ্যই জেসি’র বিখ্যাত সব ডাকাতির নাট্যরূপ, কী হয় না? প্রকৃত অর্থে একটা মারকাটারি উৎসব।
উৎসব চলুক, কিন্তু একটু ভেবে দেখবেন এই জেসি জেম্স আসলে কে? আমেরিকার এক অংশ মনে করে, ও ছিল পুঁজিবাদ-বিরোধী রবিনহুড। একা হাতে লড়ে গিয়েছিল একটা পুরনো ‘সিস্টেম’কে ধরে রাখার জন্য, যেখানে আধুনিক আমেরিকা তার নিয়মকানুন নিয়ে অবাধ যাতায়াত করবে না। কিন্তু ওর কার্যকলাপ দেখে তো ওকে রবিনহুড-এর চেয়ে বেশি, টুইন টাওয়ার আক্রমণকারীদের পূর্বসূরি বলে মনে হচ্ছে। যেমন ধরুন, গৃহযুদ্ধের সময় বা পরে জেসি শুধুমাত্র প্রতিপক্ষ ‘ইউনিয়ন’ সৈনিকদের মারত না, নির্দোষ সমর্থকদেরও কুপিয়ে খুন করত। বা ধরুন, যেখানেই ডাকাতি করছে, প্রেস বিবৃতি রেখে আসছে। যাতে সবাই জানতে পারে, এটি কার কীর্তি। অনেকটা, এখনকার সন্ত্রাসবাদীদের ই-মেল পাঠিয়ে বিস্ফোরণের দায়িত্ব স্বীকার করার মতো নয় কি? আবার খেয়াল করুন, জেসি ‘কু ক্লাক্স ক্ল্যান’-এর সাদা মুখোশ পরে ট্রেন ডাকাতিও করছে। ‘ক্ল্যান’-এর সদস্য না হয়েও, ওদের বেশ ধরে ডাকাতি করার কারণ কী? জেসি কি কোথাও একটা সন্ত্রাসবাদী সমবায় তৈরি করার চেষ্টা করছিল? আর যেন তেন প্রকারেণ দাস-প্রথার মতো একটা পুরনো কিন্তু অত্যন্ত নিন্দনীয় ব্যাপারকে বাঁচিয়ে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা অন্তত রবিনহুড করবে না। তালিবান করতে পারে। ও, আর শুনলাম, ওর লুঠ করা টাকা নাকি কখনওই ওদের দলের বাইরে বেরত না। রবিনহুডের কিন্তু অন্য নিয়ম ছিল। |