প্রবন্ধ ২...
এলেই দু’কিলো ডাল
এটাও একটা অস্ত্র বইকি
জো মাদিয়াথ মানুষটা একেবারে নিজের মতো। রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়েছিল প্রথম কৈশোরে, বাগিচা-শ্রমিকদের ইউনিয়ন তৈরি করে, সেই বাগিচার মালিক ছিলেন তাঁর বাবা! ১৯৬৯ সালে, তখনও ছাত্র, একটা সাইকেল নিয়ে ঘুরলেন এক বছর, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা। ১৯৭১, বাংলাদেশি শরণার্থীদের ত্রাণ শিবিরে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। সেই বছরেই ওড়িশায় বিরাট সাইক্লোন, বিপুল ক্ষয়ক্ষতি। সুতরাং আবার ঝাঁপ। ত্রাণের কাজ করতে করতেই ভাবলেন, এলাকার মানুষের দীর্ঘমেয়াদি উন্নতির জন্য কিছু করা যায় না? স্থিত হলেন, কাজ শুরু হল। ১৯৭৯ সালে তৈরি হল ‘গ্রাম বিকাশ’। এখন, বত্রিশ বছর পরে, গ্রাম বিকাশ ওড়িশার বৃহত্তম অসরকারি সংগঠনগুলির একটি। জো গোড়া থেকেই তার সি ই ও। তবে একটু অন্য গোত্রের সি ই ও, সুইজারল্যান্ডের দাভোস-এ বড় বড় কর্পোরেট কর্তা আর রাষ্ট্রনায়কদের বার্ষিক সম্মেলনে যান চরকায় কাটা সুতোর তৈরি পোশাক পরে, সুযোগ পেলেই নিজেকে নিয়ে নানান রসিকতা করেন, যে বস্তুটি স্যুট-শোভিত কেষ্টবিষ্টুদের ধাতে নেই।
কিছুই জানতাম না এ সব। জো মাদিয়াথের নামটাই প্রথম জানলাম খুব সম্প্রতি, এক অসামান্য বই পড়তে গিয়ে। বইটির নাম ‘পুয়োর ইকনমিকস’ (র্যান্ডম হাউস)। লিখেছেন দুই অর্থনীতিবিদ, অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং এসথার দুফ্লো। তাঁরা গ্রাম বিকাশ-এর একটি উদ্যোগের গল্প বলেছেন। ওড়িশার দরিদ্র গ্রামে জল সরবরাহের উদ্যোগ। ওঁদের প্রস্তাব ছিল, গ্রামের প্রত্যেকটি বাড়িতে জলের ব্যবস্থা করবেন, কেবল একটাই শর্ত, গোটা গ্রামের জন্য একটিই জলাধার তৈরি করবেন তাঁরা, সেখান থেকেই প্রত্যেকটি বাড়িতে জলের লাইন যাবে। এই ব্যবস্থার সুবিধে জল দেওয়ার খরচ অনেক কম। কিন্তু এর মানে হল, গ্রামের সব মানুষকে একই জল নিতে হবে। অনেক গ্রামেই উচ্চবর্ণের মানুষদের অনেকে তাতে রাজি নন, নিচু জাতের লোকে যেখান থেকে জল পাবে তাঁরা সেখানকার জল ব্যবহার করবেন কী করে? তাঁরা আলাদা জলের ব্যবস্থা চান।
তা হলে? কিছু লোকের গোঁড়ামির জন্যে গোটা গ্রাম ভুগবে? বিশেষ করে গরিব মানুষ, যাঁদের বেশির ভাগই ওই ‘নিচু জাত’-এর? ধর্মসংকট বটে! কিন্তু জো-রা বললেন, ‘হয় সবাইকে এক জায়গা থেকে জল নিতে হবে, না হলে গ্রামে জল দিতে পারব না।’ যে গ্রাম রাজি হয়, তারা জল পায়, অন্যেরা কিছু দিন গোঁ ধরে থাকে, কিন্তু ক্রমে ক্রমে, একে অন্যের দেখাদেখি, রাজি-হওয়া গ্রামের সংখ্যা বাড়ে। যে গ্রাম রাজি হয়, সেখানে গ্রাম বিকাশ কাজ শুরু করে। জলাধার তৈরি হয়, জল পরিস্রুতির ব্যবস্থা হয়, জলের লাইন পাতা হয়। পুরো ব্যবস্থাটা তৈরি হলে, প্রতিটি বাড়িতে লাইন পৌঁছলে তবে শুরু হয় জল সরবরাহ। এবং হাতে হাতে ফল। যে গ্রামে ওঁদের প্রকল্প চালু হয়, সেখানে পেটের অসুখ অর্ধেক কমে যায়, গ্রামবাসীদের, বিশেষ করে বাচ্চাদের পুষ্টি বাড়ে, স্বাস্থ্য ভাল হয়।
ঠিকঠাক জলের ব্যবস্থা করতে পারলে জনস্বাস্থ্যের যত উন্নতি হয়, তার কোনও তুলনাই নেই। এটা দুনিয়া জুড়ে বার বার প্রমাণিত হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংগঠনের (ডব্লিউ এইচ ও) একটি রিপোর্ট অনুসারে, বিশ শতকের প্রথমার্ধে দুনিয়ায় শিশুমৃত্যুর হার যতটা কমেছে তার বারো আনাই ঘটেছে পরিস্রুত জল ও সাফাই (স্যানিটেশন) ব্যবস্থার কল্যাণে। ‘জলের আর এক নাম জীবন’ কথাটা মোটেও আলঙ্কারিক নয়। গ্রাম বিকাশ-এর উদ্যোগটি তাই মনে রাখার মতো।
আর এক উদ্যোগের কথা আছে এই বইয়ে। আর একটি সংগঠনের উদ্যোগ। সংগঠনটির নাম সেবা মন্দির। ওঁরা কাজ করেন রাজস্থানের উদয়পুরে। বাচ্চাদের টিকে দেওয়ার জন্য শিবির বসান প্রতি মাসে, নিয়ম করে। গ্রামে গ্রামে প্রচার করেন: ‘শিশুদের ক্যাম্পে নিয়ে আসুন, টিকে দেওয়ান, অসুখ থেকে বাঁচান।’ কিন্তু অনেকেই আসেন না। প্রথম দু’এক বার যদি বা আসেন, পরের টিকেগুলোর জন্য আর কিছুতেই আনা যায় না বাচ্চাদের। হাজার চেষ্টার পরেও দেখা যায়, শতকরা মাত্র কুড়িটি বাচ্চাকে সব টিকে ঠিক মতো দেওয়া গেছে। অভিজিৎরা খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, গ্রামের লোক বাচ্চাদের টিকে দেওয়াতে চান না, ওতে নাকি ক্ষতি হয়, অনেকে আবার বলেন, ‘ওইটুকু বাচ্চাকে ও রকম করে বাইরে নিতে আছে নাকি? নজর লাগবে না? এক বছর বয়েস হওয়ার আগে বাড়ি থেকে বের করে কেউ?’
বিশ্বাস অতি ভয়ানক বস্তু। এই ‘সচেতন’ পশ্চিমবঙ্গে এবং তার কৃষ্টিগর্বিত রাজধানীতেই পালস পোলিয়ো কর্মসূচির অসমাপ্ত ইতিহাস আমাদের অজানা নয়। তাই সেবা মন্দিরের ওঁরা ধরেই নিয়েছিলেন যে, কিছু করার নেই, এরই মধ্যে যতটুকু পারা যায়। কিন্তু অভিজিৎরা সেবা মন্দির-এর পরিচালকদের বলে-কয়ে একটা পরীক্ষায় রাজি করালেন। একটা ক্যাম্পের আগে ঘোষণা করা হল যে, বাচ্চাকে টিকে দেওয়াতে নিয়ে এলেই দু’কিলো ডাল দেওয়া হবে, আর সমস্ত টিকে দেওয়ানো শেষ করলেই স্টেনলেস স্টিলের ক’খানা প্লেট। ব্যস, হাতে হাতে ফল। টিকে দেওয়ার হার এক লাফে সাতগুণ বেড়ে গেল। এখন ওঁরা চেষ্টা করছেন, কী ভাবে এমন উদ্যোগ আরও ছড়িয়ে দেওয়া যায়, কী ভাবে এই ধরনের ‘ইনসেনটিভ’ আরও কার্যকর করে তোলা যায়।
পৌনে তিনশো পৃষ্ঠার বইটিতে এমন অনেক গল্প আছে। নানান দেশের গল্প। সবই গরিব মানুষদের নিয়ে। তাঁদের রকমারি অভাব আর সমস্যা আর সংকট নিয়ে। ক্ষুধা, কর্মহীনতা, অপুষ্টি, অসুখবিসুখ, শিক্ষার অভাব... কী ভাবে তাঁরা বাঁচেন, লড়াই করেন, সেই বাঁচার লড়াইটাকে, আসলে বাঁচা-নামক-লড়াইটাকে কী ভাবে একটু এগিয়ে দেওয়া যায়, তারই নানা কাহিনি, সমীক্ষা, বিশ্লেষণ নিয়ে এই বই। দুনিয়া-জোড়া দারিদ্রের মোকাবিলায় কী করণীয়, সে বিষয়ে নতুন করে ভাবছেন অভিজিৎ, এসথার এবং তাঁদের সহমর্মীরা। তাঁদের ভাবনার ভিতটা খুব শক্তপোক্ত। সেটা এই যে, দরিদ্র মানুষের জীবনযাপনের একটা নিজস্ব অর্থনীতি আছে। খুব মূল্যবান, সমৃদ্ধ অর্থনীতি। তা থেকেই গ্রহণ করা যায় গ্রহণ করতে হবে অত্যন্ত মূল্যবান শিক্ষা, তার পর, সেই শিক্ষা মনে রেখে অর্থশাস্ত্রের ধারণাগুলিকে সদ্ব্যবহার করে খুঁজতে হবে দারিদ্রের সঙ্গে লড়াইয়ের পথ।
একটা পথ নয়, অনেক পথ। এবং পথের শেষ কোথায়, জানা নেই, জানা যায় বলে ওঁরা বিশ্বাসও করেন না। কোনও একটা তত্ত্ব দিয়ে, মডেল দিয়ে, বিশল্যকরণী দিয়ে কোনও এক কুরুক্ষেত্রে আঠারো দিনে ‘দারিদ্র দূরীকরণ’ হয়ে যাবে তা হয় না। তার দরকারও নেই। যুদ্ধ একটা নয়, অসংখ্য। যুদ্ধের কোনও ব্রহ্মাস্ত্র নেই, কিন্তু অস্ত্র আছে, অগণন। কোথায় কোন অস্ত্রে কাজ হয়, জেনে নিতে হবে, শিখে নিতে হবে তার প্রয়োগবিদ্যা। হতাশার কোনও প্রশ্ন নেই, কারণ প্রতি মুহূর্তে এমন অনেক যুদ্ধে অনেক অস্ত্র জয়ী হয়ে চলেছে। গ্রাম বিকাশ, সেবা মন্দির... যোদ্ধারা এক পা দু’পা তিন পা করে এগিয়ে চলেছেন। সময় লাগবে। লাগুক। ‘দারিদ্র তো আমাদের সঙ্গেই আছে বহু সহস্র বছর, যদি আরও পঞ্চাশ বা একশো বছর অপেক্ষা করতে হয়, হবে।’


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.