|
|
|
|
প্রবন্ধ ১... |
গণতান্ত্রিক, অন্তত এখনও |
আরব দুনিয়ায় যে টালমাটাল, ‘রাজনৈতিক ইসলাম’ তার
দখল পায়নি। ৯/১১-র দশ বছরে কথাটা স্মরণীয়।
গৌতম রায় |
উত্তর আফ্রিকা ও পশ্চিম এশিয়ার দেশে-দেশে গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারের দাবিতে স্বৈরাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে যে গণ-আন্দোলন দেখা দিয়েছে, গত শতাব্দীর ষাটের দশকে সমাজতান্ত্রিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে চেকোস্লোভাকিয়ায় ঘনিয়ে ওঠা ‘প্রাগ বসন্ত’-এর সঙ্গে তার তুলনা টানা হচ্ছে। এই গণ-উত্থানকে বলা হচ্ছে ‘আরব বসন্ত’। তিউনিসিয়া দিয়ে শুরু। তার পর একে-একে মিশর, বাহরিন, ইয়েমেন, জর্ডন, সিরিয়া, লিবিয়ার মুসলিম দেশগুলিতে স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে জনতার স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ অব্যাহত। এই আরব বসন্তের একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, পাশ্চাত্যে যাকে ‘রাজনৈতিক ইসলাম’ আখ্যা দেওয়া হয়, সেই জেহাদি, মৌলবাদী, কট্টরপন্থীদের নেতৃত্বে কোথাওই এই জাগরণ ঘটেনি। আদি বা শুদ্ধ ইসলামে প্রত্যাবর্তনের কোনও ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক তাগিদ বা প্রেরণা থেকেও এই বিদ্রোহ ঘটছে না। এই আন্দোলন উঠে এসেছে একেবারে রাস্তা থেকে, প্রাসাদ ষড়যন্ত্র থেকে নয়। তাই আম মুসলিম জনসাধারণই থেকেছেন এর চালিকাশক্তি। তাঁরা দাবি করেছেন রুটি, নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান, মর্যাদার সঙ্গে জীবনযাপনের অধিকার। গণতন্ত্রের জন্য তাঁদের দাবি হয়তো ইউরোপীয় ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের অনুরূপ নয়, সেখানে হয়তো এখনও যূথের ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু ন্যায়বিচার, বৈষম্যমুক্তি, প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের চেয়ে কোনও অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ গণতন্ত্র নয়। আরব বসন্তের গণতান্ত্রিক চরিত্র তাই সংশয়াতীত।
আর এখানেই বৃহত্তর মুসলিম জনসমাজে রাজনৈতিক ইসলামের উত্তরোত্তর প্রাসঙ্গিকতা হারানোর গভীর তাৎপর্যটি অনুধাবনযোগ্য। তালিবান, আল হামাস, হেজবুল্লা বা আল-কায়দায় অভ্যস্ত পশ্চিম-প্রভাবিত বিশ্বজনমত মুসলিমদের যে কোনও জাগরণের পিছনে অনিবার্য ভাবে রাজনৈতিক ইসলামকে খুঁজে নেয়। গণতন্ত্রের সঙ্গে ইসলাম সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, এই দুইয়ের বিরোধ মৌলিক, এই স্বতঃসিদ্ধ থেকেই ধরে নেওয়া হয়, আরব বসন্তের পিছনেও জেহাদি সংগঠনের কলকাঠি নাড়ার ঘটনা আছে। |
|
স্বাধীনতার স্লোগান, ইসলামের নয়। তাহরির স্কোয়ার, কায়রো। অগস্ট ২০১১। ছবি: এ এফ পি |
দুর্ভাগ্যবশত মুসলিমদের একাংশও মনে করেন, পয়গম্বর যে ভাবে মদিনা শাসন করতেন, সে ভাবেই মিশর, তিউনিসিয়া বা লিবিয়া শাসন করা উচিত। কিন্তু তাঁদের খুশি করতে তো তিউনিসিয়া-মিশর-সিরিয়ার মুসলিম জনতা রাস্তায় নামেনি। স্যামুয়েল হান্টিংটনের মতো ‘সভ্যতার সংঘাত’-এর পশ্চিমী তাত্ত্বিকদের বাধিত করতেও নয়। তাই মিশরের তাহরির স্কোয়ারের উদ্বেল জনজোয়ারে ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’-এর মতো মৌলবাদী সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবকরা মিশে থাকলেও প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারক-বিরোধী আন্দোলনের বর্শামুখ তারা রাজনৈতিক ইসলামের অনুকূলে ঘুরিয়ে দিতে পারেনি। হয়তো সে জন্য তারা প্রাণপণ চেষ্টা করেছে। কিন্তু তাতে এ যাবৎ সাফল্য পায়নি। বিদ্রোহীরা এক বারের জন্যও ইসলামের কথা উচ্চারণ করেননি। আওড়াননি নিখিল আরব জাতীয়তাবাদের কোনও স্লোগান। বরং প্রতি জুম্মাবারের নমাজের পর তাহরির স্কোয়ারে সমবেত হয়ে কায়রোর জনসমুদ্র মিশরের নব্য শাসকদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন নির্বাচন ও গণতন্ত্রের প্রতিশ্রতি পালনের কথা।
মিশরের হোসনি মুবারক থেকে সিরিয়ার আসাদ, ইয়েমেনের আলি আবদুল্লা সালে থেকে লিবিয়ার মোয়াম্মার গদ্দাফি সকলেই বিদ্রোহ দমনে পশ্চিমের সমর্থন পেতে রাজনৈতিক ইসলামের মাথা চাড়া দেওয়ার গল্প ফেঁদেছেন, আল-কায়দার কাল্পনিক তৎপরতার জুজু দেখিয়েছেন, জেহাদি সন্ত্রাসের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনেছেন। এই ভাবে তাঁরা ইসলাম বনাম পাশ্চাত্য দুনিয়ার হান্টিংটনীয় তত্ত্বকে বিশ্বাসযোগ্যতা দিতে চেয়েছেন। নিজেদের পশ্চিমের বিশ্বস্ত এজেন্ট হিসাবে তুলে ধরার এবং দীর্ঘ কাল ধরে উত্তর আফ্রিকা ও পশ্চিম এশিয়ায় মার্কিন ও ইউরোপীয় রণনীতির স্বার্থ সুরক্ষিত রাখার ‘সেবা’র পুরস্কার হিসাবে চেয়েছেন পশ্চিমী গণতন্ত্রের অনুমোদন। পশ্চিমী মিডিয়াও এ কাজে অর্থাৎ গণ-বিদ্রোহের মধ্যে জেহাদি জঙ্গিদের প্ররোচনা খুঁজে বেড়ানোয় সক্রিয় ভাবে সাহায্য করেছে। কিন্তু মুসলিম ব্রাদারহুডের মতো মৌলবাদী ইসলামি সংগঠনও দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা করেছে, মুবারক স্বৈরাচারের অপসারণ এবং প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচিত সরকার কায়েমের গণ-আন্দোলনকেই তারা সমর্থন করছে, শরিয়তি শাসন ফিরিয়ে আনার দাবি তাদের নেই।
তবে কি আন্দোলনরত এই মুসলিম উম্মাকে আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় গত শতাব্দীর খ্রিস্টীয় মুক্তিতত্ত্ব বা ‘লিবারেশন থিয়োলজি’র সঙ্গে তুলনা করা যাবে, যে-তত্ত্ব আদি খ্রিস্টধর্মের সাম্যের ভাবনার সঙ্গে শাসিতের বৈষম্যমুক্তির আধ্যাত্মিক সংযোগ ঘটিয়ে পাদ্রিদেরও বন্দুক হাতে নিতে প্ররোচিত করেছিল? কেউ কেউ তেমন তুলনা টানলেও বাস্তব এখনও তা সমর্থন করে না। কারণ জুঁই বিপ্লবের কুশীলবরা ইসলামকে সরিয়ে রেখেই গণতন্ত্রকে আবাহন করতে পথে নেমেছেন। লক্ষণীয় এই যে, লিবিয়া ছাড়া প্রতিটি মুসলিম দেশেই গণ-আন্দোলন শান্তিপূর্ণ, অহিংস থেকেছে। সন্ত্রাসীদের অংশগ্রহণ, প্ররোচনা বা নেতৃত্ব থাকলে যা আদৌ সম্ভব হত না। কোনও একটি দেশেও সরকার, সেনাবাহিনী বা রাষ্ট্রীয়তার প্রতীকস্বরূপ প্রতিষ্ঠানে নাশকতা বা অন্তর্ঘাতের ঘটনা ঘটেনি। যে দুটি মুসলিম দেশে অস্ত্রের ঝনৎকার শোনা গেছে, সেই বাহরিন এবং লিবিয়া উভয় দেশেই শাসকের প্রতি আনুগত্য ছুড়ে ফেলে সেনাবাহিনীরই বিক্ষুব্ধ অংশ জনসাধারণের শিবিরে যোগ দেয়, আর তাতেই অহিংস গণ-আন্দোলন রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধের চেহারা নেয়।
আরব বসন্তের চেহারা বরাবরই এমন থাকবে কি না, বলা কঠিন। সংগঠিত রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বের অভাব স্বতঃস্ফূর্ত গণ-আন্দোলনকে ক্রমে রাজনৈতিক ইসলামের অনুপ্রবেশের উর্বর জমি করে তুলতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, আলজিরিয়ায় যেমনটা ঘটেছিল, জনসাধারণের রায়েই এখনও দুর্বল ও ক্ষুদ্র, কিন্তু ক্রমশ সংগঠিত মৌলবাদীরা গণতান্ত্রিক ভাবেই নির্বাচিত গরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গড়ার ন্যায্য দাবিদার হয়ে উঠতে পারে। আলজিরিয়ার সামরিক বাহিনী সেই জনাদেশকে সে দিন নস্যাৎ করে অন্যায় ভাবে ক্ষমতাদখল করে। আজ একই রকম পরিস্থিতি দেখা দিলে সে-অন্যায়ের পুনরাবৃত্তি করা কঠিন হবে।
ইতিমধ্যে আর একটি দেশের ঘটনাবলি তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। মৌলবাদকে নির্বাসিত করা কামাল আতাতুর্কের স্বদেশ তুরস্ক কিন্তু ক্রমশ মুসলিম উম্মার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। তবে আতাতুর্কের কট্টর সেকুলারিজম আজকের তুর্কি শাসকরা অনুশীলন করেন না। তাঁরা সেই সেকুলার ইমারতের একটি-একটি করে ইট খসিয়ে দিচ্ছেন। ইজরায়েলের বিরুদ্ধে কঠোর হয়ে তুরস্ক ইসলামি উম্মার নেতৃত্ব হাসিল করতে চাইছে কি না, নজর রাখা দরকার। ১৯২৪ সালে কামাল আতাতুর্ক যে খিলাফতকে নির্বাসিত করেছিলেন, তার সসম্মান পুনর্বাসনের তোড়জোড় শুরু হয়নি, কে বলতে পারে? |
|
|
|
|
|