|
|
|
|
যুবকের আর্তিতে সাড়া দিল না পুলিশ-রেল, পথে মৃত্যু বৃদ্ধের |
নিজস্ব সংবাদদাতা |
হাওড়া স্টেশনে সাবওয়ের সামনের চায়ের দোকানের বেঞ্চে পড়ে রয়েছেন অসুস্থ এক বৃদ্ধ। তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য এক বার পুলিশের কাছে, এক বার রেলকর্মীদের কাছে কাকুতি-মিনতি করছেন বছর আঠাশের এক যুবক। ফোন করছেন ১০০ নম্বরেও। কিন্তু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন না কেউই।
প্রায় আধ ঘণ্টা ছোটাছুটির পরে শেষ পর্যন্ত নিজেই ট্যাক্সি ডেকে যখন তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন ওই যুবক, তত ক্ষণে মারা গিয়েছেন অলোক রায় নামের আশি বছরের ওই বৃদ্ধ। চুঁচুড়ার বাসিন্দা অলোকবাবুর একটি ছোট ব্যবসা রয়েছে ফুলবাগানে। সোমবার দুপুরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে তিনি সেখানেই যাচ্ছিলেন।
গত মাসেই আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রোড উড়ালপুলে পথ দুর্ঘটনায় আহত দু’টি কিশোরকে হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়ার জন্য সাহায্য চেয়ে নিরাশ হতে হয়েছিল আশিস চৌধুরী নামে এক যুবককে। শুক্রবার রাতে ঢাকুরিয়া ব্রিজে দুর্ঘটনার পরে পুলিশের সাহায্য চেয়ে স্ত্রী ও শিশুপুত্রের সামনেই নিগৃহীত হওয়ার অভিযোগ করেছেন গাঙ্গুলিবাগানের বাসিন্দা রাজীব সাহা।
কী ঘটেছে এ দিন?
বেলা তখন দেড়টা। শেওড়াফুলি থেকে ট্রেনে হাওড়া স্টেশনে নেমে বালিগঞ্জের বাস ধরার জন্য সাবওয়ে ধরে এগোচ্ছিলেন সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় নামের এক যুবক। বালিগঞ্জে একটি অটোমোবাইল সংস্থার কর্মী সুদীপবাবু সাবওয়ের ৫ নম্বর গেট দিয়ে উপরে ওঠার সময় দেখতে পান, টাল সামলাতে না পেরে সিঁড়িতে পড়ে যাচ্ছেন সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরা এক বৃদ্ধ। ছুটে গিয়ে তাঁকে ধরে ফেলেন সুদীপবাবু। তিনি বলেন, “বাস স্ট্যান্ডের কাছে একটি দোকানে রোজ চা খাই। চেনা ওই দোকানি বিশুদাকে ডেকে বলি, ভদ্রলোককে বেঞ্চে শুইয়ে দেওয়ার জন্য। ওঁকে একটু জল খাওয়াই। সঙ্গে সঙ্গে ফোন করি ১০০ নম্বরে।”
কিন্তু এর পরেই শুরু হয় সুদীপবাবুর অন্য অভিজ্ঞতা। তাঁর অভিযোগ, “ঘড়িতে তখন বেলা ১টা ৪৩। ১০০ নম্বরে ফোন ধরে এক ব্যক্তি বললেন, ‘ওটা আমাদের এলাকা নয়। রেল পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।’ এর পরে সাবওয়ের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক পুলিশকে দেখে ছুটে যাই তাঁর কাছে।” |
|
|
অলোক রায় |
সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় |
|
সুদীপবাবুর অভিযোগ, “ওই পুলিশকর্মী হাত নেড়ে জানিয়ে দেন, তিনি সাহায্য করতে পারবেন না। তিনি আমাকে রেল পুলিশের কাছে যেতে বলেন। রেল পুলিশকে কোথায় পাব, বুঝতে না পেরে ছুটে যাই হাওড়া স্টেশনের বড় ঘড়ির কাছে ফার্স্ট-এড কেন্দ্রে।” সেখান থেকে সুদীপবাবুকে বলা হয়, স্টেশন ম্যানেজারের সঙ্গে যোগাযোগ না করে কিছু করা যাবে না। ডেপুটি স্টেশন ম্যানেজারকেও বিষয়টি জানাতে হবে। সুদীপবাবু এর পরে যান ডেপুটি স্টেশন ম্যানেজারের ঘরে। সুদীপবাবুর বক্তব্য, সেখানে ফোনে কথা বলতে বলতে রেলের সাদা পোশাক পরা এক কর্মী তাঁকে বিষয়টি গোলাবাড়ি থানায় জানাতে বলেন। সুদীপবাবুর অভিযোগ, “চাপাচাপি করাতে ওই রেলকর্মী বার বার বলতে থাকেন, এ সব ব্যাপারে জড়ালে তাঁর চাকরি নিয়ে টানাটানি শুরু হবে। আমাকেও এ সব ঝামেলা থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দেন ওই কর্মী।” সুদীপবাবু অবশ্য তাতে কান দেননি।
কারও কাছে সাহায্য না পেয়ে শেষ পর্যন্ত বৃদ্ধকে নিজেই হাসপাতালে নিয়ে যাবেন বলে ঠিক করেন সুদীপবাবু। তিনি বলেন, “চায়ের দোকানিই একটি ট্যাক্সির বন্দোবস্ত করেন। ট্যাক্সিচালক ও তাঁর এক পরিচিত ব্যক্তির সাহায্যে ওই বৃদ্ধকে ট্যাক্সিতে তুলি।” কিন্তু বঙ্কিম সেতুর উপর উঠতেই যানজটে আটকে পড়েন সুদীপবাবুরা। অলোকবাবুকে কোলে শুইয়ে রেখেছিলেন সুদীপবাবু। তখনই বৃদ্ধের হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছিল বলে মনে হয়েছে সুদীপবাবুর। অবস্থা সুবিধের নয় আঁচ করে অলোকবাবুর পকেট থেকে মোবাইল ঘেঁটে একটি নম্বরে ফোন করেন তিনি। ফোনটি ধরেন অলোকবাবুর বোন ডলি দাস। সুদীপবাবু বলেন, “তাঁকে জানাই, অলোকবাবু অসুস্থ। তাঁকে হাওড়া জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। আপনারাও চলে আসুন।”
এমনিতে বঙ্কিম সেতু থেকে হাওড়া হাসপাতালে পৌঁছতে সময় লাগার কথা মিনিট পাঁচেক। কিন্তু এ দিন সেতুর উপরে ঠায় দাঁড়িয়ে যায় ট্যাক্সি। মঙ্গলাহাটের বিকিকিনি চলছিল সেতুর উপরেই। ফলে সার দিয়ে দাঁড়ানো গাড়ির মিছিল পেরিয়ে হাসপাতালে পৌঁছতে লেগে যায় কুড়ি মিনিটের মতো। বেলা আড়াইটে নাগাদ হাসপাতালে পৌঁছন সুদীপবাবুরা। সুদীপবাবু বলেন, “চিকিৎসকরা বৃদ্ধকে ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যান। কিন্তু দু’মিনিটের মধ্যে ফিরে এসে জানান, আর কিছু করার নেই।”
এত জনের কাছে সাহায্য চেয়েও পাননি সুদীপবাবু। কিন্তু এর মধ্যেই ট্যাক্সি চালকের ‘মানবিক মুখ’ মনে রেখেছেন তিনি। সুদীপবাবু বলেন,“যাঁদের কাছে সাহায্যের আশা করেছিলাম, তাঁরা কিছুই করলেন না। অথচ ওই ট্যাক্সি চালক সাধ্যমতো দ্রুত চালিয়ে হাসপাতালে তো পৌঁছে দিলেনই, উল্টে ভাড়াও নিলেন না। বললেন, বৃদ্ধকে বাঁচানো গেলে ভাড়া নেওয়ার কথা ভাবতাম।” সুদীপবাবুর আফসোস, একটু আগে হাসপাতালে পৌঁছতে পারলে হয়তো বাঁচানো যেত অলোকবাবুকে।
|
মানবিক অমানবিক |
• ১০০ নম্বরে ফোন করি। রেল পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়।
• সাবওয়ের কাছে মোতায়েন পুলিশও বলেন, রেল পুলিশের কাছে যান।
• প্ল্যাটফর্মের ফার্স্ট-এড কেন্দ্রে বলা হয়, ডেপুটি স্টেশন ম্যানেজারকে জানান।
• সেখানে এক রেলকর্মী বলেন, আপনি বাচ্চা ছেলে! ঝামেলা থেকে দূরে থাকুন।
• ট্যাক্সিচালক কিন্তু ভাড়া নেননি। বলেন, ওঁকে তো বাঁচাতেই পারলাম না! ভাড়া কী নেব? |
|
কেন পুলিশ বা রেলকর্মীরা ওই অসুস্থ বৃদ্ধকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন না? হাওড়া পুলিশের ডিসি (সদর) সুকেশ কুমার জৈন বলেন, “কেন ১০০ নম্বরে ফোন করার পরেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, বাসস্ট্যান্ডে গোলাবাড়ি থানার যে পুলিশ ছিলেন, তিনিই বা কেন সাহায্য করেননি, সব খতিয়ে দেখতে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।” ঘটনাটি ‘দুর্ভাগ্যজনক’ বলে মন্তব্য করেছেন হাওড়ার রেল পুলিশ সুপার মিলনকান্তি দাসও। তিনি বলেন, “যেখানে ঘটনাটি ঘটেছে, সেটি রেল পুলিশের এলাকা নয়। তবু আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখছি।” হাওড়ার স্টেশন ম্যানেজার সমীর বন্দ্যোপাধ্যায়ও বলেন, “যে সব রেলকর্মী সহায়তা করেননি, তাঁরা অন্যায় করেছেন। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখছি।”
সুদীপবাবুর ফোন পেয়েই চুঁচুড়ার পুরনো কাপাসডাঙা থেকে হাসপাতালে আসেন অলোকবাবুর ভাই, দিদি ও বোনেরা। তাঁরা জানান, অকৃতদার অলোকবাবু হৃদ্রোগে ভুগছিলেন। সঙ্গের ব্যাগে ওষুধও রাখা থাকত। এ দিন শরীরটা ভাল না থাকায় তাঁকে বাড়ি থেকে বের হতে নিষেধ করেন অলোকবাবুর ভাই অরূপবাবু। সন্ধ্যায় হাসপাতাল থেকে বাড়ি পৌঁছে অরূপবাবু বলছিলেন, “ফুলবাগানে লেদের যে কারখানা রয়েছে, সেখানে এ দিন জরুরি কাজ ছিল। তাই দাদা জোর করেই দুপুর ১২টা নাগাদ বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন।”
দোতলা বাড়িটার সামনে বাগান। বাগানের পরিচর্যা করাই ছিল অলোকবাবুর নেশা। পাঁচ ভাই, ছয় বোনের মধ্য সবার বড় অলোকবাবু। দাদাকে হারিয়ে শোকস্তব্ধ কাপাসডাঙার দোতলা বাড়িটা। |
|
|
|
|
|