অণ্ণা হজারের নেতৃত্বে পরিচালিত দুর্নীতি-বিরোধী আন্দোলন সাময়িক বন্ধ হওয়ার পর এটা বলা সহজ, এই আন্দোলনে কিছুই পাল্টাবে না। এটা বলা আরও সহজ, অণ্ণা হজারে গাঁধী নন অথবা জয়প্রকাশ নারায়ণও নন। এই তুলনা চলতে থাকবে। এও বেশ সহজেই বলা যাবে যে, দুর্নীতি রোধ উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্তের স্বপ্ন। এরা তো সমাজের অন্য সমস্যার মুখোমুখি হয় না।
অথচ, আন্দোলন যখন চলছিল, দেশের রাজধানীর জনপথে লোক বেড়েছে, কমেনি। মধ্যবিত্তকে দিয়ে যার শুরু, সেই আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন দিল্লির চার পাশের গ্রামের লোক। ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনেরও কিছু অংশ আগ্রহ দেখাতে শুরু করে। তার চেয়েও বড় কথা, সব ছাপিয়ে উঠে আসে আন্দোলনের বাস্তবতা।
রাস্তায় জনতার উপস্থিতি যেন প্রতিষ্ঠানসর্বস্ব গণতন্ত্রের প্রতি উত্তর। বিশেষজ্ঞরা জনলোকপাল বিলের খুঁটিনাটি নিয়ে মাথা ঘামাতে চান, ঘামান। কিন্তু প্রতিষ্ঠানসর্বস্ব গণতন্ত্রের প্রতি প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়া চাই। উত্তর চাই। জনপথ এবং সংসদ এবং অন্য প্রতিষ্ঠানসর্বস্ব গণতন্ত্রের মাঝে কথাবার্তা শুরু হওয়া চাই। দেশের নানা প্রত্যন্তে কথোপকথনের রাজনীতির সূচনা আগেই হয়েছিল, সে সব জায়গায় সমবেত জনতা আঞ্চলিক বিধায়ক, পুরপ্রতিনিধি, গ্রামপ্রতিনিধিদের বাধ্য করেছে নানা কথার উত্তর দিতে। আজ রাজধানীতে প্রতিদ্বন্দ্বী কথোপকথনের সূচনা হল। প্রশ্ন হল, কথাবার্তার রাজনীতিতে কারা ভীত? জনপথ না সংসদ? |
গাঁধী তাঁর সময়ে গাঁধী। জয়প্রকাশ নারায়ণ তাঁর সময়ে জয়প্রকাশ নারায়ণ। অণ্ণা হজারে তাঁর সময়ে অণ্ণা হজারে হয়ে আন্দোলন করছেন। ইতিহাসে মজে তাই লাভ নেই। জনতা রাস্তায় নামেন ঐতিহাসিক নিশ্চয়তার শক্তিতে বলীয়ান হয়ে। তবু যদি ইতিহাসের কথা ওঠে, মনে রাখা দরকার, গাঁধীজি সুভাষচন্দ্র বসুর কংগ্রেস সভাপতিত্ব মেনে নিতে অস্বীকার করেছিলেন। জয়প্রকাশ নারায়ণ গুজরাত বিহারের বিধায়কদের পদত্যাগ করতে বলেছিলেন। কারণ, নবনির্মাণ আন্দোলনের মনে হয়েছিল, এই বিধায়করা আর দেশবাসীর বা রাজ্যবাসীর ভরসার যোগ্য নন।
পৃথিবী জুড়ে গণতন্ত্রে আজ এই বৈশিষ্ট্য দেখা দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানসর্বস্বতা সর্বত্র প্রকট। সংসদের দোহাই দিয়ে সর্বত্র গোষ্ঠী শাসন। সরকারই সব, সংসদ সিলমোহর। সঙ্গে আছে এই গোষ্ঠীর সঙ্গে বণিককুলের অন্তরঙ্গতা। প্রচারমাধ্যমও এই বন্ধুত্বের অংশীদার। ব্রিটেনে এক বিশাল সংবাদগোষ্ঠী মন্ত্রীদের খবরাখবরের জোগানদার এবং অংশীদার। এই দুর্নীতি ইংল্যান্ডে, ফ্রান্সে, ইতালিতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে।
এ দেশের কথাই ধরুন। সংসদে দুর্নীতি নিয়ে দুটি প্রধান দলের মধ্যে এক নীরব সমঝোতা। এই সমঝোতার ভিত্তিতে সংসদ চলেছে বেশ কিছু বছর। জাতীয় রাজনীতি থেকে বিরোধিতাকে নির্বাসন দেওয়া হয়েছে। ডি এম কে, সমাজবাদী দল, রাষ্ট্রীয় জনতা দলের মতো নানা দলও নীরব। বিচিত্র লাগে, এই রাজ্যেও বামপন্থী নেতারা সবাই অণ্ণা হজারের আন্দোলন চলাকালীন সংসদের গুণগান গেয়ে বলেছিলেন, মাঠে-ঘাটে কি বিল তৈরি হয়? এই সংসদসর্বস্বতা না সংসদকে উন্নত করেছে, না জনপ্রিয় রাজনীতির উপকার করেছে।
অণ্ণা হজারের আন্দোলন এই নিথর রাজনীতিতে বিরোধিতার আবির্ভাব ঘটিয়েছে। গণমাধ্যমকেও বাধ্য করেছে জনতার দিকে মুখ ফেরাতে। অণ্ণা হজারে বর্তমান ইতিহাসের অচেতন যন্ত্র। তাঁর স্বকীয়তা এবং এই আন্দোলনের নানা বৈশিষ্ট্য আজকের বদ্ধ পরিস্থিতিকে খানিকটা খুলে দিয়েছে। এই জন্য এই আন্দোলন নিয়ে বুদ্ধিজীবীরা সংশয়ী। কিন্তু একই কারণে এই আন্দোলন জনপ্রিয় রাজনীতির ন্যায্যতা লাভ করেছে।
পরিশেষে একটা কথা। অনেকে এই আন্দোলনে ফ্যাসিবাদের আগমন দেখেছেন। হাজার হাজার মানুষ বারো দিন রাস্তায়। একটা হিংসাত্মক ঘটনাও ঘটেনি। কোথায় ফ্যাসিবাদ? গণতন্ত্রের সংকটের দুটো উত্তর। একটা কর্তৃত্ববাদী, ফ্যাসিবাদী পথ। অন্যটা গভীর করার পথ। সেই গভীরতার চরিত্র গণতন্ত্রকে আশু ও প্রত্যক্ষ করে তোলা। আশু গণতন্ত্র, প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের পথে প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন। আশু গণতন্ত্রের অর্থ জনতার প্রত্যক্ষ উপস্থিতি।
দেশের রাজধানীর জনপথে যে ভাবে আন্দোলন হয়েছে, সম্ভবত দেশের অন্যত্র তার পথ হবে আলাদা। ওদের নাগরিক সমাজ, আমাদের নাগরিক সমাজ এই পার্থক্যও থাকবে। ওরা দুর্নীতি নিয়ে ভাববে, আমরা ভাবব মূল্যবৃদ্ধি, শ্রমিক ছাঁটাই, কৃষক উচ্ছেদ এ সব নিয়ে। এই পার্থক্য ও বৈচিত্র থাকবে জনপ্রিয় রাজনীতির আকারে বা গঠনে। কিন্তু এই পার্থক্য থাকলেও অস্বীকার করার উপায় নেই, জনপ্রিয় রাজনীতির যুগ এসে গেছে। গণতন্ত্রকে এ বাস্তবতা মানতেই হবে। জনপ্রিয় রাজনীতিকে অস্বীকার করে, জনপথকে অস্বীকার করে আজকের যুগে গণতন্ত্রের কথা ভাবা শক্ত।
লেখক বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী, ‘ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপ’-এর অধিকর্তা |